ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ র ই শামীম

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৯ মে ২০১৯

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে  বৈশ্বিক অর্থনীতি

বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি যে হারে বাড়ছে, তাতে করে ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রসমূহের অর্থনীতিই ভবিষ্যতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রসমূহের অর্থনীতিও গভীর সঙ্কটের মুখে পড়বে। ইউরোপিয়ান ইকোনমিক ফোরামের মতে, আগামী দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারাবে। সম্প্রতি নানা সমীক্ষা ও গবেষণায় এই আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। আগামী কয়েক দশকে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। বিশ্বের ১৮৪টি দেশের মানুষ ও অর্থনীতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ডিআরএ এর এক প্রতিবেদনে অনেক আগেই বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি কমবে জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)সহ নানা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক সমীক্ষা ও গবেষণায় আগামী দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা সত্যি আশঙ্কাজনক। গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে মজবুত অর্থনীতির দেশগুলো সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি অনেক দেশের অর্থনীতির জন্য এখনই তা নতুন সঙ্কট হিসেবে ভাবার কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি দি ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গভীর সঙ্কটে পড়বে। যদি এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষতির মুখে পড়বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। দেশটির মধ্যপশ্চিম অঞ্চলে ফসল না হওয়া, ক্যালিফোর্নিয়ায় ভয়াবহ দাবানল এবং দক্ষিণে পরিকাঠামো ক্ষতির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১৯৮০’র দশকের মতো রফতানি ও যোগানের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে। অপরদিকে ২০১৮ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের মতে, প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি অনুযায়ী যদি বিশ্বের সব দেশ মিলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়, তবে বৈশ্বিক জিডিপির পরিমাণ ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। কিন্তু যদি তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তবে জিডিপি হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ শতাংশে। আবার কেউই যদি কিছু না করে বসে থাকে, তবে ২১০০ সালের মধ্যে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, ফলে ২০১০ সালের তুলনায় জিডিপি ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। আইএমএফের সাম্প্রতিক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্র ও উপকূলীয় দেশগুলোর অর্থনীতির মোট প্রবৃদ্ধির ১০ শতাংশ হারিয়ে যেতে পারে। প্যারিস চুক্তির প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনে, বিশ্ব অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা উল্লেখ করেছে। আইএমএফ সূত্র মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশ এবং ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়াও উপকূলীয় কম্বোডিয়া, চীন, মিসর, গায়ানা, সুরিনাম, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের অর্থনীতিও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেইসঙ্গে তাপমাত্রা আরও বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট কৃষি, বনজ, উপকূলীয় আবাসন ব্যবস্থা এবং পর্যটন খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া আগামী কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসার ঝুঁকির কবলে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় অর্ধেক অঞ্চল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে আগামী কয়েক দশকে তাপমাত্রার পরিবর্তন ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যের কারণে অর্থনীতি এ ক্ষতির মুখোমুখি হবে। বিশ্বব্যাংক ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব যাচাই এবং কোন অঞ্চল কতটা ঝুঁকির মুখে পড়বে তা নিয়ে এক সমীক্ষা পরিচালনা করে। এ সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ৮০ কোটির বেশি মানুষ ভয়াবহ হটস্পটগুলোতে বাস করছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মারাত্মক হটস্পটগুলোতে বাস করা বাংলাদেশীরা আবহাওয়ার গড় পরিবর্তনের কারণে মাথাপিছু জিডিপির দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে তাতে তাদের আয় কমবে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। সেই তুলনায় ভারত ও শ্রীলঙ্কানদের আয় কমবে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক অর্থনীতিবিদের মতে, জলবায়ু হটস্পটের সঙ্গে পানি সঙ্কট এলাকাগুলোর এক ধরনের যোগসূত্র রয়েছে। ফলে জলবায়ুগত ক্ষয়ক্ষতির প্রভাবে ৬০ কোটি ভারতীয় চরম পানি সঙ্কটে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সময় বদলে যাচ্ছে, ফলে কৃষি উৎপাদন আগামী দশকগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সব বিষয় এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে মারাত্মক সঙ্কটে ফেলবে। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর জলবায়ু ও অর্থনীতিবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক কী প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক দিয়ে মালদ্বীপ ও নেপাল সবচেয়ে ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। দেশ দুটির চলতি শতাব্দী শেষে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষতি ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা নেপালের প্রায় কাছাকাছি। এক্ষেত্রে ভারত ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ভুটান ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। এছাড়া প্রতিবেদনে আরোও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়া এখন থেকে প্রতিবছর, কমপক্ষে ৭৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে শুধু নয়, জলবায়ু পরিবর্তন আজ গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ, তা আমরা জানি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশ নানা উদ্যোগ গ্রহণের পরও বিশ্বব্যাপী মতানৈক্য দূর হয়নি। ইতোমধ্যে বায়ুম-লে অতিরিক্ত পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশে গেছে, তা যদি রোধ করা না যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে? চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, জার্মানি এসব দেশই বেশিরভাগ কার্বন নিঃসরণ করছে। তবে আশার কথা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ছে। কোন দেশ কার্বন নির্গমন হার কমানোর জন্য কার্বন ট্যাক্স আরোপ করছে। চীন, ডেনমার্ক, জার্মানী ও সুইডেন মাংস, দুধ ও পোল্ট্রি শিল্পে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করেছে। অনেক দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বাড়াচ্ছে। বনভূমির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ২৬-২৮ শাতাংশ কম গ্রিন হাউজ নির্গমনের ব্যাপারে ১৯৫টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এসব উদ্যোগের পরও প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তবে আর কোন পদক্ষেপই জলবায়ু পরিবর্তনকে আটকে রাখতে পারবে না। অর্থাৎ যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যর্থ হই, তাহলে বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতিই নতুন করে গভীর সঙ্কটে পড়বে। শেষে এর পরিণতি আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
×