ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে গঙ্গাচড়ার বেনারসী পল্লী

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৮ মে ২০১৯

 ঈদ ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে গঙ্গাচড়ার বেনারসী পল্লী

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১৭ মে ॥ ঈদ-উল-ফিতর সামনে রেখে তাঁতের মাকুরের খট খট শব্দে মুখরিত এখন গঙ্গাচড়া উপজেলার তালুক হাবু গ্রামের বেনারসী পল্লী। বেনারসী শাড়িসহ থ্রিপিস ও পাঞ্জাবি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই তাদের ব্যস্ততা বাড়ছে । ঈদ উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী বেনারসী শাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়াতেই তাদের এ ব্যস্ততা। এখানে উৎপাদিত শাড়ি চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরের অভিজাত বিপণিবিতানে। সময়মতো অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই দিতে রাতেও কাজ করছেন কারিগররা। সবমিলিয়ে সেখানে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। কাজের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটলেও বেশি রোজগারের আশায় কারিগর এবং তাঁতিদের কোন ক্লান্তি নেই। তাদের চোখে-মুখে এখন শুধুই আনন্দের ঝিলিক। রংপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামে গড়ে উঠেছে এ বেনারসী পল্লী। এক সময় এ বেনারসী পল্লীর সুনাম ছিল দেশজুড়ে। তখন এখানে প্রায় ৬শ’ তাঁত ছিল। কিন্তু উৎপাদিত কাপড়ের বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, পুঁজির অভাব, শ্রমিক সঙ্কট, স্থানীয়ভাবে সুতা না পাওয়া এবং প্রসেসিং ও কাটিং মেশিন না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ টিতে। তবে, বর্তমানে দেশজুড়ে বেনারসীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে জেগে উঠেছে ঝিমিয়েপড়া এই তাঁত পল্লীটি। বেনারসী বিক্রির জন্য গঙ্গাচড়ার নিভৃত পল্লীতে গড়ে উঠেছে খুচরা ও পাইকারি বড় আকারের ৭/৮টি চোখ ধাঁধানো শোরুম। সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে নিট কাতান, জামদানি, অপেরা, ফিগা, রেশমি কাতান, ফুলকলি, দুলহান, মিলেনিয়াম, বেনারসী কসমস, অরগে-ি, রিমঝিম কাতান, প্রিন্স কাতানসহ কত যে বাহারি নামের শাড়ি, থ্রিপিস এবং পাঞ্জাবি !! বেনারসী শাড়ি অনেকের কাছে কাতান শাড়ি নামেও পরিচিত। বিসিকের এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৫ পর্যন্ত প্রায় ১০০ তাঁতি এবং সাড়ে তিন শ’ তাঁতকল ছিল ওই এলাকায়। এখানকার পণ্যের মানও ছিল অনেক ভাল। বিপণন ও আর্থিক সমস্যার কারণে এক সময় মুখ থুবড়ে পড়ে এ শিল্প। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় বেশিরভাগ কারখানা। বেকার হয়ে পড়েন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ হাজার কারিগর। বেকার শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে ২০০৭-২০০৮ সালে এ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় রংপুর বিসিককে। এ টাকা দিয়ে ৪০টি তাঁত বসানো হয়। তিনি জানান, বিসিক মানুষের চাহিদা ও রুচির প্রতি নজর রেখে কারিগরদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। তাঁত মালিকদের সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। ওই এলাকায় ৬৭টি পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে তাঁত স্থাপনের জন্য ৬৮০ বর্গফুট আয়তনের ৪০টি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। এসব শেডে চলছে বেনারসী শাড়ি তৈরির কাজ। সেখানেই প্রদর্শনী কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বেনারসীর চাহিদা এখন অনেক বেড়েছে। ফলে, বেনারসীর সুদিন আবার ফিরে আসার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ফাইয়াজ বেনারসীর স্বত্বাধিকারী ফরিদা রহমান জানান, বর্তমানে কারিগরদের মজুরি বেশি হওয়ায় লাভ কম হচ্ছে। এক বছর আগেও একটি শাড়ি তৈরিতে রকমভেদে মজুরি দিতে হতো ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। বর্তমানে দিতে হয়, ১১শ’ থেকে ১৩শ’ পর্যন্ত। রং ও সুতার দামসহ উৎপাদন খরচ মিটিয়ে প্রতিটি শাড়িতে তার ৫/৭শ’ টাকা লাভ হয়। তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে স্থানীভাবে বেনারসীর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, রংপুরেই তার তিনটি শোরুমে বেনারসী বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাকি পণ্য তিনি ঢাকার মিরপুরে পাঠান। নিশাত বেনারসীর স্বত্বাধিকারী আব্দুল কুদ্দুস জানান, কয়েক বছর থেকে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন উৎসবে বেনারসী পল্লীর কাপড় বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কিন্তু স্থানীয় বাজারে সুতা পাওয়া যায় না। সুতা আনতে হয় ঢাকার মিরপুর থেকে। এসব কারণে দাম বৃদ্ধি পায়। বেনারসী পল্লীর কারিগর আশু মিয়া, হামিদুল, জয়দেব, আল আমিন, রেজাউল, মোসলেমা ও কুলসুম জানান, একটি শাড়ি তৈরি করে পাওয়া যায় ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। থ্রিপিসে পান ৯শ’ থেকে ১১শ’ টাকা এবং পাঞ্জাবিতে পান ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদের পরিশ্রম যেমন বেড়েছে, রোজগারও বেড়েছে। এতে তারা খুবই খুশি। তাঁত মালিক রোস্তম মিয়া জানান, এক সময় তার নিজের ৩০টি তাঁত ছিল। পুঁজি সঙ্কট, কাঁচামাল ও বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। এখন তিনি নিঃস্ব। সরকার এ শিল্পের দিকে নজর দেয়ায় আবার তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কারখানার মালিক ফরিদা আখতার জানান, তার এখানে আটটি তাঁত রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টাই চলছে কাজ। আগে যেখানে সপ্তাহে ১৬টি শাড়ি তৈরি হতো, সেখানে এখন ৩০টি তৈরি হচ্ছে।
×