ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

৭১ এর এই দিনে ॥ ৮ মে, ১৯৭১ ॥ টিক্কা খান দালালদের খুশি করতে ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়

প্রকাশিত: ১২:০৬, ৮ মে ২০১৯

৭১ এর এই দিনে ॥ ৮ মে, ১৯৭১ ॥ টিক্কা খান দালালদের খুশি করতে ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়

১৯৭১ সালের ৮ মে দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন কর্নেল এমএজি ওসমানী, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ, সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন এবং কয়েক ভারতীয় অফিসার ভারতের কদমতলায় এক জরুরী সভায় মিলিত হন। সভায় মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে সেই অনুসারে নির্দেশ দেন। মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী সন্ধ্যায় দিনাজপুরের ভজনপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগান। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বাংলাদেশের আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৭২ হাজার ২২০ জন। গবর্নর টিক্কা খান দালালদের খুশি করতে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেয়ার অজুহাতে ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ করে। এই অর্থ পরে বিভিন্ন এলাকায় বাঙালী নিধনে পাকসেনাদের প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী পাকিস্তানের সেবক শান্তি কমিটির দালাল ও রাজাকারদের ভাগ্যে জোটে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মাতৃভূমি পাকিস্তান রক্ষার জন্য জনগণকে আত্মোৎসর্গের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মাতৃভূমির ঘাতকরা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের ধ্বংস করতে না পারলে ইসলামকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, খুলনা থেকে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পীরজাদা মোহাম্মদ সাঈদ সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, জনাব সাঈদ পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিতে বিশ্বাস স্থাপন করে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানান এবং পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টায় লিপ্ত রাষ্ট্রদ্রোহী শক্তিসমূহের নিন্দা করেন। খুলনার চরেরহাট নদীর কূলে মাছ কোম্পানির জেটিতে জাহাজ লাগিয়ে মাছ রফতানি করা হতো। এই দিন যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার রঘুনাথপুর থেকে সকাল ৮টায় ২টা লঞ্চ খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। বেলা ১১টার দিকে চরেরহাটের কাছাকাছি পৌঁছায়। তখন পাক সেনারা ২টি গানবোটে দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং সারেংকে লঞ্চটি মাছ কোম্পানির জেটিতে লাগাতে হুকুম করে। এরপর সকল যাত্রীকে নামিয়ে তিন শ’র অধিক পুরুষকে তিন ভাগে ভাগ করে মাছ কোম্পানির পূর্ব পাশের দেয়ালের কাছে, খালিশপুর হাই স্কুলের পাশে এবং রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে, বিকেলে স্থানীয় লোকজন মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দেয়। শিল্প ও বণিক সমিতির অনারারি এ্যাডমিনিস্ট্রেটর আশরাফ ডব্লিউ তাবানী জানান, সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারীদের চক্রান্ত নস্যাত করেছে, সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে তারা পিছু হটেছে, এবার সবাইকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে অংশ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ’ সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোহ কেটে যাচ্ছে। এরা নিশ্চিহ্ন হবে। কেন্দ্রীয় সিরাত কমিটি বায়তুল মোকাররম মসজিদে এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বক্তারা বলেন, আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া বিদ্রোহীরা (মুক্তিযোদ্ধারা) ধ্বংস হয়েছে। ভারত তার গুপ্তবাহিনীর সহায়তায় এ দেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু শান্তিপ্রিয় জনগণ ও সেনাবাহিনী তাদের বিতাড়িত করেছে। সেমিনারে জামায়াত নেতা গোলাম আযমসহ মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী, আলাউদ্দিন আল আজাহারী, ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল্লা গফুর ও ড. হাবিবুল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ফরিদপুর জেলার কানাইপুরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এদেশীয় রাজাকার ও বিহারীরা। পাক সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ রাতে আদিম উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালী জাতির ওপর। তাদের হিংস্র নখরে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয় বাংলার জনপদ। পাক হানাদারদের বর্বর গণহত্যা ও দানবীয় হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববিবেক। তাদের এই বিবেক বর্জিত ও মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে বিশ্বজনমত। পক্ষান্তরে দৈনিক সংগ্রাম সামরিক জান্তা কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সমর্থন করে এবং খুনী পাক সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। পত্রিকাটি পাক সামরিক সরকারের মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের সর্মথনে নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করায় এবং তাদের নিন্দনীয় কাজে গর্ববোধ করে এই দিন ‘সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা’ শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে- অবৈধ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গত ২৬ মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এঁটে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। সামরিক সরকার তা জানতে পেরেই পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতে আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাঁর সে পরিকল্পনা নস্যাত করে দেন এবং পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। এই দিন ইউএনআইএর উদ্বৃতিতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বিভিন্ন সেনাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের আমচকা আক্রমণ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে কমা-ো আক্রমণে প্রায় ১৫ জন পাক ফৌজ খতম হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহে কালুমাখানায় পাকবাহিনীর আমচকা আক্রমণ করে কমান্ডোরা ৮ জনকে হত্যা করে এবং ৩০টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়। এর পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে রংপুরে। এখানে সরাই নামক স্থানে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে অন্তত ৭ জন সৈন্যকে হত্যা করে। শ্রীহট্ট অঞ্চলের বিবির বাজার ও কাজিপুরে জোড় সংঘর্ষ হয়। হতাতের খবর পাওয়া যায়নি। রংপুরের আমরখানা, মোগলহাট, লাবলাহাট ও তুগরাইহাট অঞ্চলে মুক্তিফৌজ গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছে। তারা ওই জেলার বাজানপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে বরিশালের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এদিন পটুয়াখালী অঞ্চলের এখানে সেখানে যুদ্ধ চলছে। জলপাইগুড়ি থেকে যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছে : মুক্তিফৌজ বিগত ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর রণাঙ্গনে নেকীপাড়া, ডানাকাটা এবং বড়শশী সীমান্ত ফাঁড়িগুলো দখল করে নিয়েছেন। তাঁরা ভালাগঞ্জ থেকে পচাঁগড় পর্যন্ত ২০ ব্যাসার্ধের মধ্যে পাক সৈন্যদের চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে। বহুসংখ্যক মুক্তিফৌজ এখন তেঁতুলিয়ায় গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছেন। এই দিন বাংলাদেশের খ্যাতনামা ফুটবল খেলোয়াড় ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশের কোন এক স্থানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে আছেন। ক্যাপ্টেন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দেয়ার জন্য পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করেছেন। দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ আজ সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। সকলের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তাঁর মর্ম এই রকম : বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়া এই দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি বা সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কি করবেন তার কোন আভাস দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে তিনি বলেন, কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আজ এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক পূর্বনির্ধারিত ছিল না। বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরেই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী স্বল্প সময়ের নোটিশে তার সহকর্মীদের ওই বৈঠকে আহ্বান করেন। এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে শ্রীমতি গান্ধী বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে সহকর্মীদের অবহিত করেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×