ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিক্সার পালাবদল- হাতে ঠেলা থেকে পায়ে, এখন ব্যাটারিচালিত

প্রকাশিত: ১১:০১, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

রিক্সার পালাবদল- হাতে ঠেলা থেকে পায়ে, এখন ব্যাটারিচালিত

সমুদ্র হক ॥ পালকির বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবিত রিক্সার পালাবদল ঘটছে। মূল কাঠামো ঠিক রেখে রিক্সা এখন একবিংশ শতকের উপযোগী। মানবচালিত মনুষ্যবাহী ত্রিচক্রযান বর্তমানে ইলেকট্রো মেকানিক্যাল প্রযুক্তিতে দ্রুতগতির হয়েছে। কখনও এই রিক্সা পাল্লা দিচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার সঙ্গে। একটা সময় শহর ও নগরের দৃশ্যের অন্যতম পরিচিতি ছিল পায়েচালিত (প্যাডেল) রিক্সা। তিন চাকার এই বাহনে বাইসাইকেলের মতো সিটে চালক সামনে বসে পিছনে এক বা দুইজন যাত্রী বসিয়ে প্যাডেলে (পায়ের শক্তিতে) চেনের মাধ্যমে চাকা ঘুরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের সকল শহরে স্বল্প দূরত্বে রিক্সা ছিল পাবলিক পরিবহনের অন্যতম বাহন। রিক্সার পিছনে চিত্রনায়ক নায়িকার ছবি আঁকা হতো। বলা হতো ফোক আর্ট। সাইনবোর্ড লেখার অনেক শিল্পী এ ধরনের ছবি এঁেক সিনেমার ব্যানারে ছবি আঁকার সুযোগ পেয়েছে। বছর দশক আগেও পায়েচালিত রিক্সাই ছিল রিক্সার মূল পরিচিতি। রিক্সাওয়ালা (চালক) তার কায়িক শ্রমে যত দ্রুত পা দিয়ে প্যাডেল ঘুরাত তত দ্রুত রিক্সা চলত। এই শক্তিতে রিক্সার পাল্লাও হতো। ২০১১ সালে এই রিক্সার আধুনিকায়নের পালা শুরু হয়। রিক্সাওয়ালার কায়িক শ্রম কমিয়ে দিতে রিক্সায় ব্যাটারি সংযুক্ত করা হয়। ব্যাটারির বিদ্যুতের শক্তিতে মোটর ঘূর্ণনে রিক্সার চাকা ঘুরানোর প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়। রিক্সার স্টিয়ারিংয়ে (হ্যান্ডেল) থাকে ইগনিশন (চাবি) সংযুক্ত ছোট কন্ট্রোলার বক্স ও ব্রেক। চালক স্টার্ট দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণে রিক্সা চালায়। এই রিক্সা দেখতে পায়েচালিত রিক্সার মতোই। ব্যাটারির চার্জ কমে গেলে চালক প্যাডেলে পায়ের শক্তিতে রিক্সা চালিয়ে নেয়। এরপর নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ব্যাটারি চার্জ দেয়। এই রিক্সার যাত্রী আসনের নিচে ব্যাটারি ও পিছনের চাকার ধারে মোটর থাকায় অনেক সময় চালক ব্যালান্স হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। হালে এই অবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে। রিক্সার গঠন পাল্টে স্পোকের বড় চাকার বদলে স্কুটারের চাকার মতো ছোট চাকা বসিয়ে উচ্চতা কমানো হয়েছে। বাকি প্রযুক্তি ডিসি ভোল্টের ব্যাটারি ও বিভিন্ন হর্সপাওয়ারের (অশর্^শক্তি) মোটর ইত্যাদি ঠিক রেখে ইলেকট্রো মেকানিক্যাল প্রযুক্তিতে শক্তি বাড়ানো হয়েছে। শক এ্যাবজর্বার থাকায় ঝাঁকুনি কমেছে। রিক্সাচালকের আসন, স্টিয়ারিং, যাত্রীদের বসার আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। চালক ও যাত্রী উভয়েরই রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ ধরনের রেক্সিনের ফোল্ডিং ছাউনি রাখা হয়েছে। অনেকটা আগের দিনের মোটরগাড়ির মতো। এই ধরনের রিক্সার উচ্চতা কম ও চাকা ছোট হওয়ায় দুর্ঘটনা কম। দিনে দিনে এই রিক্সা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রিক্সাগুলো আরামদায়ক। ভাড়া সহনীয়। রিক্সার উৎপত্তি ইতিহাস ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের। পালকির বিকল্প হিসেবে জোনাথন স্কোবি নামের একজন জাপানী নাগরিক দুই চাকার একটি যানকে হাতে ঠেলে টানার বাহন উদ্ভাবন করেন। জাপানী ভাষায় নাম দেন ‘জিনরিকিসা’। জিন অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি ও সা অর্থ বাহন। পরে নাম হয় রিক্সা। জাপান থেকে এই রিক্সা ছড়িয়ে পড়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে। সবচেয়ে বেশি ছড়ায় পূর্ব এশিয়ায়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কলকাতায় মালপত্র বহন করে ঠেলাগাড়ির মতো দুই চাকার রিক্সা। ১৯১৪ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি হাতে টানা রিক্সায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ১৯২০ সালে কলকাতায় পায়েচালিত রিক্সাও (সাইকেল রিক্সা) চালু হয়। ততদিনে একদার ব্রহ্মদেশ (বার্মা) বর্তমানের মিয়ানমারের রেঙ্গুনে রিক্সা প্রবেশ করে। ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে রিক্সা আসে চট্টগ্রামে। তার আগেই কলকাতা থেকে পায়েচালিত রিক্সা আসে ঢাকায়। ওই সময়ে নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব পরিবহনের জন্য কলকাতা থেকে সাইকেল রিক্সা আনেন। একই সময় চীনে ক্রীতদাসরা চাকাযুক্ত চেয়ারে মালিকদের ঠেলত। রিক্সার এই অগ্রযাত্রায় শহর নগর মহানগরের পরিচিতি হয়ে ওঠে রিক্সা। যা আজও আছে। ঢাকা মহানগরীতে অনেক সড়কে রিক্সা চলাচল নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকায় রিক্সার সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ। যার বেশিরভাগই পায়েচালিত। ইন্টারনেট থেকে জানা যায় ২০০৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় হাতে টানা রিক্সাকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর হাতে টানা রিক্সা মালিক সমিতি এই ঘোষণাকে উল্টো অমানবিক বলে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে ইলেকট্রো মেকানিক্যাল প্রযুক্তির সর্বশেষ আধুনিকায়নের রিক্সার সংখ্যা বাড়ছে। এই রিক্সার জনপ্রিয়তা বেশি। যাত্রীরা এই রিক্সায় চলাচলে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। বর্তমানে পায়েচালিত রিক্সার দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। মোটর ও ব্যাটারিচালিত রিক্সার দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সর্বশেষ আধুনিক ছোট চাকার ইলেকট্রো মেকানিক্যাল রিক্সার দাম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। বগুড়া নগরীতে দিনে দিনে এই রিক্সার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তরুণ চালকরা এই রিক্সা কিনে সড়কে নামিয়েছে। শহর নগর ছাড়িয়ে এই রিক্সা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামের উন্নত সড়কে। ষাটের দশকে ঢাকার চলচ্চিত্রে রিক্সাওয়ালকে নিয়ে গান হয়েছে। তালাশ ছবিতে রিক্সাওয়ালার ভূমিকায় সুভাষ দত্তের ঠোঁটে বশির আহমেদের কণ্ঠে গান ‘রিক্সাওয়ালা মাতওয়ালা’ সিনেমা দর্শকদের মুখে মুখে ফিরত। আধুনিক রিক্সার সঙ্গে রিক্সাওয়ালারা হয়ে উঠছেন রিক্সা ড্রাইভার বা রিক্সা অপারেটর।
×