ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় জোর করে বিয়ে দেয়া তরুণীর মুক্তি মিলল নিউইয়র্কে

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

ঢাকায় জোর করে বিয়ে দেয়া তরুণীর মুক্তি মিলল নিউইয়র্কে

বিডিনিউজ ॥ স্কুলের থিয়েটারের শিক্ষক ক্যারি এলমান-লারসেন আগস্টের এক রাতে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের প্রসপেক্ট পার্কের দক্ষিণ পাশের এলাকায় হাঁটতে বেরোন, কয়েক মিনিট যেতেই টানা-হ্যাঁচড়ারত দুই নারী-পুরুষের সামনে চলে আসেন তিনি। তরুণীকে জোর করে ধরে তার পথ আটকে ছিল লোকটি, তার থেকে ছুটতে প্রাণপণ চেষ্টায় ছিল মেয়েটি। তাদের ভাষা না বুঝলেও ‘কিছু একটা ঝামেলা’ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।এক সময় তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘সব কিছু ঠিক আছে?’। জবাব দেয় লোকটি, মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে বলে, তার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে তার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না এলমান-লারসেন। এর মধ্যে ওই দম্পতিকে ঘিরে দাঁড়ান কয়েক লোক। তারা এলমান-লারসেনকে বলেন, তাকে আমাদের সঙ্গে আসতে দিন। এটা একটি বাঙালী সমস্যা। আমরা তাকে সাহায্য করব। তবে সন্দিগ্ধ এলমান-লারসেন চাইছিলেন মেয়েটি তার সমস্যার কথা নিজের মুখে বলুক। এক পর্যায়ে মেয়েটি ইংরেজীতে বলেন, ‘জোরপূর্বক বিয়ে। আমি নিরাপদ নই। দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন।’ এরপরই সেখানকার এক বাসিন্দা জরুরী সেবার নম্বর ৯১১-এ ফোন করেন। পুলিশ এলে মেয়েটি তাদের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে অস্বীকৃতি জানান। পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে স্বামীর সঙ্গে বাসায় যেতে বলেন। তখন এলমান-লারসন পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, আমার মনে হচ্ছে, এখানে কিছু একটা ঘটছে। আমি ঠিক জানি না বিষয়টা কী, তবে সে (মেয়েটি) যা বলছে তা পুরো ঘটনা বলে আমার মনে হচ্ছে না। পরে ওই রাতেই এলমান-লারসনের কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন জাহান নামের ২০ বছরের মেয়েটি। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভিবাসী নারী ঘরে নিপীড়নের ঘটনা চেপে যান তাদের আর কোন সুযোগ নেই ভেবে, তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন জাহান। দেশে ফেরত পাঠানোর ভয় ও পরিবারকে বিপদে ফেলাÑ এসব চিন্তা থেকে নিপীড়নমূলক ওই সম্পর্কের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে চলে ওই নারীদের বসবাস। জাহান জানান, এ ঘটনার তিন মাস আগে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন তিনি। ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে ছিলেন জাহান, পড়তেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০১৭ সালের এক বিকেলে জাহানের বাবা-মা এসে তাকে বলেন, অতিথি আসছে এবং তিনি যেন ভাল কাপড় পরে সেজেগুজে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৩০ বছরের আমেরিকান প্রবাসী ছেলেকে নিয়ে বাসায় আসেন এক প্রবীণ দম্পতি। ওই ছেলের সঙ্গে জাহানের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। ওই সময়ের ঘটনা স্মরণ করে জাহান বলেন, আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, শুনেই প্রশ্ন করি, কী? ‘আমি কাঁদতে শুরু করলাম।’ বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের মতো জোরপূর্বক বিয়েও এক বড় সমস্যা। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, এদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। তবে ১৬ বছরে বিয়ে হওয়া মায়ের চেয়ে ভিন্নভাবে জীবনটা সাজাতে চেয়েছিলেন জাহান। লেখাপড়া শেষ করে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন তিনি। এর আগেও কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব এলে সেগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এবার উপায় না দেখে বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি তাদের বলেছিলাম, দয়া করে এটা করো না। আমাকে কিছুটা সময় দাও। দুই-তিন বছর পর আমি বিয়ে করব। কিন্তু দয়া করে এখন এটা করো না। কিন্তু নাছোড় বান্দা বাবা-মা বলতে থাকেন, এখনই বিয়ের সময়। বিয়ের পর স্বামীর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুদিনের জন্য মধুচন্দ্রিমায় যান এই দম্পতি। বোনের কথা চিন্তা করে জাহানের বড় ভাইও গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। ভোর ৪টার দিকে ভাইয়ের হোটেল কক্ষের দরজার ধাক্কা দেন জাহান। ‘ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং অঝোরে কাঁদতে ছিল। আমাকে বলে, ভাই, আমাকে বাঁচাও,’ টেলিফোনে বলেন জাহানের ওই ভাই। স্পাউস ভিসার জন্য আবেদন করতে কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন জাহানের স্বামী। তখন দেশে জাহান তার পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এ বিয়ে থেকে তাকে মুক্তি দিতে। এক পর্যায়ে ডিভোর্সের জন্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হন জাহান। বিষয়টি জানতে পেরে তাকে ‘পতিতা’ বলেও গালি দেয় পরিবারের লোকজন। এরপর তার লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরে আটকে রাখা হয়, পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতন। টেলিফোনে ওই ঘটনা স্বীকার করেছেন জাহানের মা ও বড় ভাই। বড় ভাই বলেন, ‘ও খুবই বিমর্ষ ছিল। ওই সময় সে যে কোন কিছুই করতে পারত।’ এরপর নিয়তির কাছে নিজেকে ছেড়ে দেন জাহান। বছর ঘুরতেই তাকে নিতে বাংলাদেশে আসে জাহানের স্বামী। সে সময় তাদের সম্মানে একটি পার্টিও দেয়া হয় এবং ওই সময় ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে দাঁড়ান জাহান। পরে দুজন একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন গত বছর মে মাসে। নিউইয়র্কের বাসায় প্রথম রাতে জাহান স্বামীকে বলেন, তাদের এখন একজন আরেকজনকে চেনাজানা উচিত। একসঙ্গে সিনেমা দেখা, হাত ধরে শহরে ঘোরাÑ এসবের মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো এই জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন বলে স্বামীকে বলেন তিনি। তবে সেগুলোতে সায় ছিল না স্বামীর। তিনি এটাকে দেখতেন বিয়ের অধিকার হিসেবে। কিন্তু জাহানের কাছে বিষয়টি ছিল দুজনের সম্মতির, একসঙ্গে চাওয়ার।
×