ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্যের প্রভাব শহুরে সংস্কৃতিতে

অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা ॥ আজ পহেলা বৈশাখ নববর্ষ ১৪২৬

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা ॥ আজ পহেলা বৈশাখ নববর্ষ ১৪২৬

মোরসালিন মিজান ॥ নাচে ঐ কাল-বোশেখি/কাটাবি কাল বসে কি?/দে রে দেখি/ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি...। সকল অমানবিক অশুভ অপশক্তির ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়ার বৈশাখ এসেছে। রবিবার ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর বর্ষবরণের মহোৎসবে যোগ দেবে গোটা দেশ। এই বিশেষ দিনে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির আলোয় নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালী। শেকড়ের শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে। মানুষের ভেতরে শুভ বোধ মানবিক চেতনা জাগ্রত করার আহ্বান জানানো হবে। বছর শুরুর এই ক্ষণে নতুন নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। ঐতিহ্য মেনে হালখাতা খুলবেন ব্যবসায়ীরা। সরকারী ছুটির দিনে রাজধানীসহ দেশে একযোগে চলবে লোকজ ঐতিহ্যের নানা উৎসব অনুষ্ঠান। নববর্ষের সূচনালগ্নে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙলীর নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। যতদূর তথ্যÑ এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তার আমলে প্রবর্তন হয় বাংলা সন, বঙ্গাব্দ। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাস অবশ্য বেশি দিনের না হলেও, আদি সাহিত্যেও বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজ সম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। সৌরমতে বৈদিক যুগে বছর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের। পেছনের যত ক্ষত ভুলে এ সময় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে বাঙালী। শুভ সূচনা হয় পহেলা বৈশাখে। কবিগুরুর ভাষায়: মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...। পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে নতুন বছর। এবারও দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে, সব ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালী। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের সব শেণী-পেশার মানুষ আজ একাত্মা হয়ে গাইবে: এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ ...। আনন্দ উৎসবে কাটাবে। কবিগুরুর ভাষায়- নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে/শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে ...। একই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেন, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর ...। আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কিষান-কিষানী। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশের জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে বসবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম-বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলাদেশ। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক চমৎকার বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের অধুনাতম নববর্ষ এ দেশের গ্রীষ্মকালীন উৎসব ও কৃষি উৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নব সংস্করণ। এর ঐতিহ্য প্রাচীন কিন্তু রূপ নতুন, নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে এমন এক নতুন আবহ যাকে একটা দার্শনিক পরিম-ল বলে উল্লেখ করতে হয়। এ পরিমন্ডলে পুরনো বিলীন জীর্ণস্তূপ নিশ্চিহ্ন, মিথ্যা বিলুপ্ত ও অসত্য অদৃশ্য। আর নতুন আবির্ভূত নবজীবন জাগরিত সুন্দর সম্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত কালবৈশাখীই এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ সহচর। নব সৃষ্টির অগ্রদূত সুন্দরের অগ্রপথিক ও বিজয়কেতন। ছায়ানটের সঙ্গে দিন শুরু ॥ রাজধানীতে বর্ষবরণ মানেই ছায়ানট। অন্তত শুরুটা ছায়ানটের সঙ্গে হয়। একই নিয়মে আজ রমনা বটমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন শ’খানেক শিল্পী। অনুষ্ঠানে ১৩টি সম্মেলক গানে গাওয়া হবে। বাকি ১৩টি একক। রবীন্দ্র নজরুলের গান যথারীতি থাকছে। গাওয়া হবে ফকির লালনের মানবতাবাদী গান। অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, সলিল চৌধুরী, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্যের সৃষ্টি সম্ভার থেকে কিছু গান বেছে নেয়া হয়েছে। থাকছে ভাটি বাংলার লোক সাধক শাহ্ আবদুল করিম ও কুটি মনসুরের গান। সবশেষে ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন তার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানাবেন বলে জানা গেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সকাল নয়টায় শুরু ॥ বর্ষবরণ উৎসবের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনটি মঙ্গল শোভাযাত্রা। ক্রমে এটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠেছে। পেয়েছে ইউস্কোর স্বীকৃতি। শোভাযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এবারও আয়োজনে যোগ দেবেন হাজার হাজার মানুষ। অনুষদের ডিন নিসার হোসেন জানান, এবার ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ স্লোগানে সকাল ৯টায় শুরু হবে শোভাযাত্রা। এখন বিভিন্ন রাস্তায় মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে। এ কারণে চলার পথে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল মোড় পর্যন্ত যাবে না। চারুকলা থেকে বের হয়ে শাহবাগ চত্বর, শিশুপার্ক, টিএসসি হয়ে আবারও একই স্থানে এসে শেষ হবে। অবশ্য টিএসসি পর্যন্ত যাবে কিনা সে বিষয়ে কিছুটা সংশয় আছে বলেও জানান নিসার হোসেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪২৬ এর মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকছে পাখি, ঘোড়া, মহিষ, হাতি, মাছ, বক, ট্যাপা পুতুলসহ ৭টি শিল্পকাঠামো। এগুলোর মাধ্যমে বাঙালীর লোক ঐতিহ্যকে উর্ধে তুলে ধরা হবে। এদিকে, একই ধরনের আয়োজন করছে দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে সারাদেশেই মঙ্গলের বার্তা ছড়িয়ে পরবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঋষিজের অনুষ্ঠান শিশু একাডেমির সামনে ॥ ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটিও বেশ পুরনো। অনেক বছর ধরে হচ্ছে। এবারও শিশুপার্ক সংলগ্ন মঞ্চে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করবে ঋষিজ। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল সাড়ে ৭টায়। একক ও দলীয় সঙ্গীতে নতুন বছরকে বরণ করে নেবেন আয়োজকরা। থাকবে আলোচনাও। হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ ॥ আজ সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। অনুষ্ঠানে একসঙ্গে এক হাজার শিল্পী গান করবেন। সম্মেলক গানে বরণ করে নেয়া হবে নতুন বছরকে। বিশাল আয়োজনের পুরোভাগে রয়েছেন খ্যাতিমান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আয়োজকরা জানিয়েছেন, অনুষ্ঠান উপভোগ করতে উপস্থিত থাকবেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংও। মানিক মিয়া এভিনিউতে আলপনা ॥ গ্রামীণ ঐতিহ্যের আরেক অনুষঙ্গ আলপনা। মানিক মিয়া এভিনিউতে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে চলে আলপনা আঁকার কাজ। খামারবাড়ি মোড় থেকে আসাদ গেটের প্রান্ত পর্যন্ত সড়কে আলপনা আঁকার কাজ করেন শিল্পীরা। অনেক রাত পর্যন্ত চলে আলপনা আঁকার কাজ। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ নববর্ষ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে দেশবাসীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের ঐক্যকে আরও সুসংহত করবে বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। রাষ্ট্রপতি বলেন, আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষি, ব্যবসা, পার্বণসহ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বাংলা সনের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাঙালীর জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন তাই চিরন্তন ও সর্বজনীন। সকল অশুভ ও অসুন্দরের ওপর সত্য ও সুন্দরের জয় কামনা করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পহেলা বৈশাখে বাঙালী সংস্কৃতির যে চর্চা হয় তা আমাদের জাতিসত্তাকে আরও বিকশিত করে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগায়। শেখ হাসিনা বলেন, বর্ষবরণের উৎসবে এ চেতনাকে নস্যাত করার জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। আঘাত করা হয়েছে বার বার। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তির কোন অপচেষ্টাই সফল হয়নি। বাঙালী জাতি নববর্ষকে ধারণ করেছে তার জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। নববর্ষে রাজনীতির নামে আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা ও দেশের সম্পদ ধ্বংসকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
×