ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কূটনীতিকরা বিএনপির ওপর বিরক্ত

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 কূটনীতিকরা বিএনপির ওপর বিরক্ত

শরীফুল ইসলাম ॥ যখন তখন কারণে অকারণে বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে বিএনপি। আর এ দলটি অতীতে বেশ ক’বার ক্ষমতায় থাকায় কূটনীতিকরাও সৌজন্যের খাতিরে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারছেন না। তবে এভাবে কথায় কথায় ডেকে সময় নষ্ট করায় বিএনপির ওপর বিরক্ত তারা। এ কারণে অধিকাংশ দেশের কূটনীতিকরাই এখন আগের মতো আসেন না। আর যেসব দূতাবাসের কর্মকর্তা বিএনপির ডাকে এখনও সাড়া দেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ দেশেরই অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তারা আসেন। এদিকে বিএনপির ডাকে আগের মতো বিদেশী কূটনীতিকরা সাড়া না দেয়ায় দলটির এ তৎপরতা এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এর ফলে বার বার বৈঠক করেও কোন সফলতা পাচ্ছে না দলটি। আগে কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি একটি বৈঠক করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈচৈ পড়ে গেলেও এখন আর এ নিয়ে কোন আলোচনা হয় না। বরং বার বার বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে বিরক্ত করায় বিএনপিই রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপে রাখতে বিএনপি ঘন ঘন বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। তখন কূটনীতিকরাও নিয়মিত তাদের ডাকে হাজির হতেন। যে কারণে ওইসব বৈঠক বেশ গুরুত্ব পেত। বিএনপির কূটনীতিক তৎপরতার ফলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করতে জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত বাংলাদেশে আসেন। এ ছাড়া তখন বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচন করে নতুন সরকার গঠন করে। আর এ সরকারকে বিশ্বের সকল দেশই স্বাগত জানায়। এর ফলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। এদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের চেয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন দাবি আদায় করার কৌশল হিসেবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও বিএনপি ঘন ঘন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক অব্যাহত রাখে। আর এসব বৈঠকে কূটনীতিকরাও নিয়মিত অংশ নিতে থাকে। বিশেষ করে গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে তার মুক্তি ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করতে আন্তর্জাতিক লবিং আরও জোরদার করতে থাকে বিএনপি। এ জন্য ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সহযোগিতা কামনার পাশাপাশি বিদেশে দৌড়ঝাঁপ ও দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চিঠি চালাচালি করা হয়। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি দেয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘ সদর দফতর ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও একাদশ জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার বিষয়ে সহযোগিতা চান। তবে বিএনপি অতীতে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াওসহ নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে বিদেশী কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন না পাওয়ায় খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও বিএনপিকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি বিদেশীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিদেশী কূটনীতিকরা বিএনপির ডাকে ভালভাবেই সাড়া দেয়। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করা ও এ দলটিকে নিয়ে নির্বাচনী জোট করায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশীদের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পায়নি বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির পর প্রথম দু’একটি বৈঠকে বিদেশী কূটনীতিকদের ভাল সাড়া থাকলেও এর পর আস্তে আস্তে তারা বিএনপির ওপর বিরক্ত হয়। তাই এ দলটি ক’দিন পর পর কূটনীতিকদের নিয়ে বৈঠক করতে থাকলেও এসব বৈঠকে বিদেশীদের উপস্থিতি ক্রমেই কমতে থাকে। আর যেসব দেশের কূটনীতিকরা আসেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিজ নিজ দেশের অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা। জানা যায়, বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া কূটনীতিকদের নিয়ে যখনই বৈঠক আয়োজন করা হয় তার ক’দিন আগে থেকেই প্রথমে চিঠি দিয়ে এবং পরে ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের আগমনের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারপরও আগের মতো আর তারা সাড়া দেয় না। সূত্র মতে, বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে ইদানীং বিএনপি দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, সে সময় অনেক কূটনীতিকই বিব্রতবোধ করেন। বিশেষ করে লিখিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করে বিএনপি। এসব দেখেও বিদেশীরা বিরক্ত হন। তবে সৌজন্যতার কারণে তারা কিছু বলেন না। এমন কি বৈঠক শেষে আগের মতো কূটনীতিকরা মিডিয়ার সামনেও কোন কথা বলেন না। এভাবে ঘন ঘন বিদেশী কূটনীতিকদের ডাকা অব্যাহত রাখলে বিএনপির ডাকে তারা আর সাড়া নাও দিতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দলের বিদেশবিষয়ক কমিটি এখন খুবই সক্রিয়। এ কমিটির সদস্যরা নিয়মিত ঢাকায় কর্মরত বিদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন মাধ্যমে যোগোযোগ রাখেন। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বৈঠক ডেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের বিভিন্ন বিষয় অবহিত করা হয়। এর বাইরে কখনও কখনও বিভিন্ন তথ্য তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবার কখনও কখনও কূটনীতিকরাও বিএনপির কাছে বিভিন্ন তথ্য জানতে চান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সারাদেশে নির্বাচনে অনিয়মের কিছু তথ্য-প্রমাণ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে বিএনপি। এতে নির্বাচনের দিন দলের পুলিং এজেন্ট কেন্দ্রে থাকতে না দেয়া, ব্যালট পেপারে সিল মারা, দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা এবং প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের নামে মামলাসহ বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। নির্বাচনের ক’দিন পর কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে এ ডকুমেন্টারি তাদের কাছে পৌঁছে দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন সিনিয়র নেতা। এ সময় কোন কোন দেশের কূটনীতিকরা প্রশ্ন করেন কেন তাদের দল জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনী জোট করল। তবে এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি বিএনপি নেতারা। এ কারণেও কূটনীতিকরা দলের নেতাদের ওপর বিরক্ত হন বলে জানা যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আবারও নতুন উদ্যমে বিদেশীদের কাছে ধরণা দেয়া শুরু করে বিএনপি। সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি অভিযোগ করে এ জন্য দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে বিদেশীদের সহযোগিতা চায়। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই নতুন সরকার ও দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বার্তা পাঠানোর কারণে বিএনপি বিদেশীদের কাছে ধরণা দিয়ে তেমন সুবিধা আদায় করতে পারেনি। এ যাত্রায়ও বিএনপি সফল না হওয়ার কারণ হচ্ছে, দেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। আর খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে। যেখানে নিজের দেশে অনিয়ম হচ্ছে সেখানে অন্য দেশের নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকরা কি করে সোচ্ছার হবে? বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, কূটনীতিকদের সঙ্গে দলীয় নেতাদের বৈঠক নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আসা হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যেটি বেশ ক’বার ক্ষমতায় ছিল দেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেই পারে। আর উন্নয়ন সহযোগী দেশের কূটনীতিকরাও সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই পারেন।
×