ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মরিচ্চাপ নদী এখন নালা ॥ গড়া হয়েছে ইটভাঁটি

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১১ এপ্রিল ২০১৯

মরিচ্চাপ নদী এখন নালা ॥ গড়া হয়েছে ইটভাঁটি

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ মরিচ্চাপ একটি মৃত নদীর নাম। সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে আশাশুনি পর্যন্ত এক সময়ের খরস্রোতা মরিচ্চাপ এখন একটি শীর্ণ নালা। যে মরিচ্চাপে এক সময় নৌকা, লঞ্চ চলত সেই মরিচ্চাপের বুকে শুষ্ক মৌসুমে এখন ছেলেরা ফুটবল খেলে। বর্ষায় ভরাট মরিচ্চাপের পানি ভাসিয়ে নেয় তীরবর্তী গ্রামগুলো। দখলের কারণে আড়াই শ’ ফুটের মরিচ্চাপ এখন দশফুটে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা দিয়ে মরিচ্চাপ খনন করা হলেও সেই মরিচ্চাপের এখন কোন অস্বিত্ব নেই। মরিচ্চাপ দখল করে গড়ে উঠেছে ইটভাঁটি। ষাটের দশকের শেষের দিকে মরিচ্চাপের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করে এই নদীর মিষ্টি পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। জোয়ারে পলি বাহিত লোনা পানি ঢুকিয়ে স্লুইসগেট বন্ধ করে দিয়ে পরিকল্পিত ভাবেই মেরে ফেরা হয় মরিচ্চাপকে এমন অভিযোগ পরিবেশবিদদের। এই মরিচ্চাপ এখন সাতক্ষীরাবাসীর জন্য অভিশাপ। ভেঙ্গে পড়া নিষ্কাশন ব্যবস্থা আর ভয়াবহ জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে এখন মরিচ্চাপ বাঁচানোর দাবি উঠেছে। মরিচ্চাপ খনন করে আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে হারানো মরিচ্চাপকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার দাবি এখন জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। স্লোগান উঠেছে- মরিচ্চাপ বাঁচলে বাঁচবে সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরার প্রাণ কপোতাক্ষ, বেতনা, মরিচ্চাপ, সাপমারা নদী এখন মরে গেছে। গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে এই পরিবেশ বিপর্যয়ের সূচনা ষোড়শ শতাব্দীতে। গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে গঙ্গা নির্ভর উপকূলীয় জেলা খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নদীগুলোতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমতে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের নদীগুলোতে জোয়ারের চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১নং পোল্ডার ভুক্ত ৭২ হাজার হেক্টর জমির পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মরিচ্চাপ নদী এখন অস্তিত্বহীন। পলি ভরাটের কারণে মরিচ্চাপ এখন পার্শ্ববর্তী বিল এলাকা থেকে অনেক উঁচু হয়ে গেছে। মরিচ্চাপের বেশিরভাগ এলাকা এখন চলে গেছে অবৈধ দখলে। নদীর সংযোগ আশাশুনির খোলপেটুয়ার সঙ্গে শালখালি স্লুইসগেট পর্যন্ত নদীতে সামান্য জোয়ার-ভাটা চললেও শালখালি থেকে সাতক্ষীরার বালিথা স্লুইসগেট পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার নদী এখন সম্পূর্ণ ভরাট ও মৃত। আশাশুনির খোলপেটুয়ার সঙ্গে কামালকাটি দিয়ে মরিচ্চাপের সংযোগ ছিল সাতক্ষীরার বালিথা ১৫ ভেন্টের স্লুইস পর্যন্ত। বালিথায় সাতক্ষীরার খাল ও বাকাল খালের সংযোগে মরিচ্চাপের শুরু। সাতক্ষীরার খাল ও বাকাল খাল কিছুটা বেঁচে থাকলেও মরিচ্চাপ বেঁচে নেই। বালিথা স্লুইসগেট ও কামালকাটি স্লুইসগেট ও টিকেট স্লুইসগেট ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মরিচ্চাপের পানি নিষ্কাশেনের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। মরিচ্চাপ এখন মরা নদী। বালিথা থেকে শুরু করে শালখালি স্লুইসগেট পর্যন্ত মরিচ্চাপের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। কামালকাটি থেকে আশাশুনির খোলপেটুয়া পর্যন্ত দৈর্ঘ আরও ১৫ কিলোমিটার। ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের পর সত্তর দশকের শেষে ও আশির দশকের প্রথমে দু’দফায় শালখালি খালের কামালকাটিতে এবং ইছামতি নদীর শাখরায় স্লুইসগেট তৈরি করার পর থেকে নদী তার আপন গতি হারাতে থাকে। পরিকল্পিত ভাবেই মরিচ্চাপ নদীকে মূল নদীর সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে টিকেট খালের মুখে মরিচ্চাপকে শাসন করতে নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। ১৯৭২ সালে নির্মাণ করা হয় মরিচ্চাপের মুখে শালখালি খালে কামালকাটিতে ৪ ভেন্টের স্লুইসগেট। ১৯৭৭-৭৮ সালে শাখরা ১৫ ভেন্টের স্লুইসগেট নির্মাণের পর ক্রমান্বয়ে মরিচ্চাপ ও এর সংযোগে আরও ১২টি স্লুইসগেট তৈরি করা হয়। গত বিশ বছরের মধ্যে মরিচ্চাপ ও এর সংযোগ খালগুলো ভরাট হয়ে বালিথা থেকে শালখালি পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার মরিচ্চাপ নদীর সম্পূর্ণ মৃত্যু ঘটেছে। এ ছাড়া মরিচ্চাপ নদীর ওপর ব্যাংদহা বাজারে ২০০৪-০৫ সালে এলজিইডি একটি ব্রিজ নির্মাণ করে। ব্রিজ নির্মাণের পরেই মরিচ্চাপ টিকেট পর্যন্ত মরে যায়। নদীর মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে পিলার তৈরি করায় নাব্য হারানো মরিচ্চাপ দ্রুত তার গতিপথ হারিয়ে ভরাট নালায় পরিণত হয়। বিশ্ব উষ্ণতা জনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সমুদ্র উপকূলীয় সুন্দরবনাঞ্চলীয় সাতক্ষীরা খুলনা ও বাগেরহাট জেলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। এ জন্য সাতক্ষীরাকে বাঁচাতে ইতোমধ্যে পানিবিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিকরা প্রথমেই সিএস রেকর্ড অনুযায়ী মূল নদীকে চিহ্নিত করে মরিচ্চাপ নদীর ওপর সকল স্থাপনা ও দখল উচ্ছেদ করার দাবি করেছেন। এ ছাড়া নদী খনন শেষ না করা পর্যন্ত নদীটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি মরিচ্চাপের আশাশুনির সংযোগ স্থানে ক্রসড্যাম দিয়ে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করার কথা বলছেন। এর সঙ্গে শহরের প্রাণসায়র, বাকাল, টিকেট, শ্রীরামপুর, ও লাবণ্যবতী খালের সংযোগে ভরাট হয়ে যাওয়া খালগুলো সংস্কার ও পুনঃখনন করেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হারিয়ে যাওয়া সাতক্ষীরার নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে খাল ও নদী খননের পরই শাখরা স্লুইসগেট, টিকেট ও কামালকাটি স্লইসগেট প্রয়োজনে অপসারণ করে ইছামতির সঙ্গে মরিচ্চাপের সরাসরি জোয়ার-ভাটার সংযোগ স্থাপিত হলেই পানি মরিচ্চাপ হয়ে চলে যাবে আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীতে। একই সঙ্গে বাঁচবে খোলপেটুয়া। অবাধ জোয়ার-ভাটায় নদী ফিরে পাবে তার হারানো গতিপথ। আর এ জন্য শাখরায় ইছামতির সঙ্গে বসানো শাখরা গেট খুলে দিয়ে আন্তঃনদী সংযোগ করতে পারলেই মরিচ্চাপের সঙ্গে সরাসরি ইছামতির সংযোগে মরিচ্চাপ ফিরে পাবে তার হারানো গতিপথ। আর আন্তঃনদী সংযোগ পেলেই বাঁচবে মরিচ্চাপ, বাঁচবে সাতক্ষীরা।
×