ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অন্যের জীবন বাঁচিয়েও বাঁচলেন না মহৎপ্রাণ সোহেল রানা

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৯ এপ্রিল ২০১৯

অন্যের জীবন বাঁচিয়েও বাঁচলেন না মহৎপ্রাণ সোহেল রানা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অন্যের জীবন বাঁচিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বনানীর এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকা-ে উদ্ধার কাজ চালানোর সময় আহত ফায়ার ফাইটার সোহেল রানা। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই মহৎপ্রাণ মানুষটি টানা দশ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতেই শেষ পর্যন্ত রবিবার রাত সোয়া দুটার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মহানুভব এই মানুষটির এমন মৃত্যুতে পথে বসার যোগাড় পরিবারটির। সোমবার রাত পৌনে এগারোটায় তার লাশ সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসে। আজ মঙ্গলবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এর পর সরকারী ব্যবস্থাপনায় মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নেয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পরিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে এই বীরকে। সোহেল রানার মৃত্যুতে পরিবারে বইছে মাতম। পনেরো দিনের দীর্ঘ ছুটি নিয়ে মায়ের কোলে ফেরা হলো না তার। চিরতরে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে সারাজীবনের জন্য মায়ের কাছে লাশ হয়ে ফিরলেন সোহেল রানা। এসব কথা বলছেন আর বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন সোহেল রানার মা আর পিতাসহ ভাই বোনরা। পরিবারের এমন শোকের মাতম যেন ছড়িয়ে পড়েছে তার পুরো গ্রাম থেকে গোটা দেশে। দেশের সর্বত্রই সোহেল রানার অসম সাহসিকতা আর মহানুভবতার বিষয়টিই আলোচিত হচ্ছে। এদিকে সোহেল রানার পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার জন্য সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই ফায়ার হিরোর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসসহ বিভিন্ন মহল। সোহেল রানার বিষয়ে তারই চাচাত ভাই করিমগঞ্জ কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র শহীদুল ইসলাম শহীদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে জন্ম সোহেল রানার। পিতা গ্রামের দরিদ্র কৃষক নুরুল ইসলাম। জমি বলতে তেমন কিছুই নেই। বাড়িভিটা ছাড়া মাত্র পাঁচ শতাংশ চাষের জমি আছে। এই সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা চাষ করে তাদের সংসার চলত। মা মোছাঃ হালিমা খাতুন। অভাবের সংসারে চার ছেলে আর এক মেয়ে। এক সময় চাষবাস করে সংসার চললেও সোহেল রানার পিতার স্ট্রোক হওয়ার পর প্যারালাইসড হয়ে যায়। এর পর সংসারে ভয়াবহ অভাব নেমে আসে। সোহেল রানা ভাইদের মধ্যে বড়। আর ভাই-বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। সবার বড় সোহেল রানার বোন সেলিনা। তিনি বিবাহিত। এর পর সোহেল রানা। অভাবের সংসারে পড়ালেখা করতে পারেননি। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। এর পর বাড়ির পাশের চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করে। টাকার অভাবে লেখাপড়া চালাতে পারছিল না। অটোরিক্সা চালিয়ে আর টিউশনি করে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করে। পরের বছরই ২০১৫ সালে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি হয়। বলতে গেলে তার আয়েই চলত পুরো পরিবারের ভরণপোষণসহ ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়া। সোহেল রানার ছোট রুবেল। সে করিমগঞ্জ কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছিল। রুবেলের ছোট উজ্জ্বল করিমগঞ্জ কলেজের ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর সবার ছোট দেলোয়ার দশম শ্রেণীর ছাত্র। ভাইদের লেখাপড়া করাতে সোহেল রানা লেখাপড়া ছেড়ে ফায়ারম্যানের চাকরি নেয়। আর রুবেল লেখাপড়া ছেড়ে গ্রামেই অটোরিক্সা চালাচ্ছে। সোহেলের মৃত্যুতে পরিবারটির এখন পথে বসার যোগাড় । একটি টিনের দোচালা ঘরে বাবা-মা, চাচা-চাচিসহ সবাই থাকেন গাদাগাদি করে। কিশোরগঞ্জ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে জানান, সোহেল রানা অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের ছিলেন। বাড়ি এলে আশপাশের লোকজনের খোঁজখবর নিতেন। চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান জানান, সোহেল রানা একটি অমায়িক ছেলে ছিল। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় আমরা তাকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেছি। বাড়ি এলেই স্কুলের খোঁজখবর নিত। সোহেল রানার বাড়িতে শত শত মানুষ ভিড় করছে। পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে সোহেল রানার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। তা আর হলো না। এসব বলতে বলতেই বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সোহেলের মা, পিতা আর ভাই-বোনরা। সোহেল রানার মৃত্যুতে পুরো গ্রামে শোক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই শোক ছড়িয়ে গেছে পুরো দেশেই। যেভাবে আহত হয়েছিলেন সোহেল রানা ॥ গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। আগুনে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশত। সোহেল রানা কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। আগুন লাগার খবরে দায়িত্ব পালন করতে বনানীর এফআর টাওয়ারে ছুটে যান। তিনি উঁচু ল্যাডার (মই) দিয়ে আগুন নেভানো ও আটকেপড়াদের উদ্ধারে কাজ করছিলেন। ভবনে আটকেপড়া পাঁচজনকে উদ্ধার করে ল্যাডারে থাকা নির্ধারিত জায়গায় রাখেন। প্রতিটি ল্যাডারের ধারণক্ষমতা থাকে। ওই ল্যাডারটির ধারণক্ষমতা ছিল মানুষভেদে ছয় থেকে সাত জন। ল্যাডারে সোহেল রানার সঙ্গে আরও দুজন ফায়ারম্যান এবং উদ্ধার হওয়া পাঁচজন থাকায় ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। অতিরিক্ত ওজনের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ল্যাডারটি বন্ধ হয়ে যায়। আর নিচে নামছিল না। এ সময় সোহেল রানা ইচ্ছে করলেই কাউকে উপরে রেখে নিচে নামতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। অন্যের জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলেন। সবাইকে ল্যাডারে রেখে তিনি ল্যাডারের নিচ দিয়ে বেয়ে নামার জন্য থাকা সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। এতে করে ল্যাডারের ওজন কমে যায়। ওজন কমার কারণে ল্যাডারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এ সময় সোহেল রানার একটি পা চলন্ত ল্যাডারের ভেতরে ঢুকে যায়। তার পা কয়েক টুকরো হয়ে যায়। তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচ- চাপ লাগে। এতে করে তার পেট ছিদ্র হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েন সোহেল রানা। দ্রুত উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। প্রতিদিন তাকে চার ব্যাগ করে রক্ত দিচ্ছিলেন সহকর্মীরা। তারপরও প্রত্যাশা অনুযায়ী সোহেল রানার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক নির্দেশনায় গত ৫ এপ্রিল সোহেল রানাকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। ভর্তি করা হয় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। তার দেখাশোনা করার জন্য ফতুল্লা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রায়হানুল আশরাফকেও সঙ্গে পাঠানো হয়। সেখানে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়। সবকিছু বিফল করে দিয়ে রবিবার রাত সোয়া দুটার দিকে চিরতরে চলে যান এই কিংবদন্তীর ফায়ার ফাইটার। ঢাকায় আসছে সোহেল রানার মরদেহ ॥ ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, সোমবার রাত পৌনে এগারোটায় সোহেল রানার মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। তার আগে সিঙ্গাপুরে কিছু ফরেনসিক ফরম্যালিটিজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইসলামিয়া বাস্কেট কোম্পানির কাছে সোহেল রানার মরদেহ হস্তান্তর করেছে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে করে মরদেহ আসছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনাল থেকে এ্যাম্বুলেন্সযোগে মরদেহ নিয়ে রাখা হবে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে। সোহেল রানার পরিবারকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মঙ্গলবার সোহেল রানার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় জানাজার ব্যবস্থা করা হবে। এরপর মরদেহ সরকারী ব্যবস্থাপনায় গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ সোহেল রানার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এহসানুল করিমের পক্ষে সহকারী প্রেস সচিব ইমরুল কায়েস গণমাধ্যমে এ শোক বার্তা পাঠান। শেখ হাসিনা শোকবার্তায় বলেন, অন্যের জীবন রক্ষার্থে, নিজের জীবন উৎসর্গের ক্ষেত্রে সোহেল রানা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাজ্জাদ হুসাইন সোহেল রানার পরিবারকে সহায়তা করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রগুলো জানিয়েছে।
×