ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারের অন্তত ৯ পয়েন্ট দিয়ে এই মানব পাচার হচ্ছে

উত্তাল সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার চলছেই

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৬ এপ্রিল ২০১৯

 উত্তাল সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার চলছেই

ফিরোজ মান্না ॥ মালয়েশিয়ায় মানবপাচার থামছেই না। সাগর পথে আবার পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবার তাদের টার্গেট রোহিঙ্গা। পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশীকেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাছ ধরার নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে পড়ে বহু মানুষ বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন উত্তাল সাগর। অনেকেই মালয়েশিয়া পৌঁছতে পারলেও সেখানে আবার তারা পুলিশের হাতে আটক হচ্ছেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পুলিশ সাগর পথে যাওয়া ৫৬ জনকে আটক করেছে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বঙ্গোপসাগর দিয়ে মাছ ধরার নৌকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে টেকনাফ থেকে কয়েক দফায় ৩শ’র বেশি রোহিঙ্গাসহ কয়েক বাংলাদেশীকে আটক করেছে। ’১৫ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সাগরে ডুবে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে কয়েকটি বড় গণকবর পাওয়া যায়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে মানবপাচার বন্ধের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিছু দিন মানবপাচার বন্ধ থাকার পর আবার এটি শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, কক্সবাজার উপকূল হয়ে মানবপাচার চলছে। কিছুতেই থামছে না পাচার। কমপক্ষে ৬০ স্থান দিয়ে মানবপাচার হচ্ছে। কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা, উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদী, পিএমখালী, চকঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা রিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়াসহ অন্তত ৬০ স্থান (পয়েন্ট) দিয়ে সাগর পথে মানবপাচার করা হচ্ছে। ১২০ কি মি পুরো উপকূল। দীর্ঘ এই উপকূল নিরাপদ রাখতে বিজিবি ও পুলিশ তৎপর থাকলেও পাচারকারী চক্র তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাগরপথে প্রতি বছর কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষকে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয় বলে স্থানীয় প্রশাসন জানায়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসন সব সময় প্রস্তুত থাকলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পাচারকারী কেউ কেউ ধরা পড়লে আইনের ফাঁক দিয়ে আবার তারা জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ সূত্রমতে, পাচারকারীরা দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করলেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা বাংলাদেশীদের সংগ্রহ করছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাসহ ১৯ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৬ বাংলাদেশী নাগরিক রয়েছে। তাদের বাড়ি রংপুর, দিনাজপুর, হবিগঞ্জসহ নানা এলাকায়। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে টাকা ছাড়াই লোকজনকে কক্সবাজার নিয়ে আসার শত শত দালাল রয়েছে চক্রের। কক্সবাজারের দালালের হাতে লোকজন তুলে দিলেই মাথাপিছু পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাই মানবপাচার এখন লাভজনক ব্যবসা। সূত্রমতে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু হলে ’১৫ সালের মতো যে কোন সময় বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পাচারকারীরা নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টাকে বেছে নিয়েছে। কারণ এই সময়টাতে সাগর অনেকটা শান্ত। সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের সাগরপথে নৌকায় করে পাচার করে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া অভিমুখী বিপদসঙ্কুল এই যাত্রায় অনেক সময় ছোট নৌকায় অতিরিক্ত লোক থাকায় সেগুলো সাগরে ডুবে যায়। এতে অনেকের মৃত্যুও হয়। মানবপাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানবপাচার হয় মালয়েশিয়া ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালের মাধ্যমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল এগেনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) সূত্রমতে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
×