ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্মেলনের এক বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি ছাত্রলীগের

প্রকাশিত: ১১:২৬, ৩১ মার্চ ২০১৯

সম্মেলনের এক বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি ছাত্রলীগের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এবার ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটির অনুমোদন দিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সেক্রেটারি স্বাধীনতা দিবসে লাখো নেতাকর্মীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ছাত্রলীগের ‘অনন্য উপহার’ লিখে তারা বলেছেন, ‘নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে কমিটি ঘোষণার পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে যথাযথ নেতৃত্বের কাছে অনুমোদনের জন্য জমা দিতে হবে, অন্যথায় ওই কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে।’ অথচ আলোচিত সম্মেলনের মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্বে এসে আজ যারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে কড়া নির্দেশ দিচ্ছেন সেই নেতারা প্রায় এক বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি কবে হবে কমিটি এর মিলছে না উত্তর। এমনকি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুতে বড় ধাক্কা খাওয়ার পরও। ঘটনায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রতিটি নেতাকর্মী। কেন্দ্র ও ঢাবি নেতৃত্বে বাড়ছে দূরত্ব। ডাকসুতে বড় ধাক্কার পেছনেও আছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকার ফলে সৃষ্ট সাংগঠনিক বিরোধÑ এমন মন্তব্য করে ক্ষ্ব্ধু নেতাকর্মীরা বলছেন, উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ এই ছাত্রসংগঠনে নিয়মিত সম্মেলন ও সাংগঠনিক জবাবদিহিতা চায় তৃণমূলের কর্মীরা কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একক আধিপত্য ধরে রাখতেই কমিটি দিতে বিলম্ব করছেন, যা সংগঠনের ভাবমূর্তিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। নেতাকর্মীরা আরও বলছেন, কেবল কেন্দ্রীয় কমিটিই নয়, প্রায় এক বছরে কোন কমিটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এর প্রভাব জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগ কমিটি পর্যন্ত বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার মূল কারণ হিসেবে শীর্ষ নেতৃত্বের একক আধিপত্য ধরে রাখার মনোভাব, ‘পকেটম্যান’দের সামনের সারিতে রাখার তীব্র চেষ্টা ও নতুন সদস্য নিয়ে সাবেক ও বর্তমান নেতাদের ভাগ-বাটোয়ারার মানসিকতাকে দায়ী করছেন নেতাকর্র্মীরা। তারা হতাশ হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরছেন শীর্ষ দুই নেতার কথা আর কাজের অমিলের চিত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে গত ২৬ মার্চ দেয়া নেতাদের বিজ্ঞপ্তি। যেখানে তারা বলেছেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্য চাতক পাখির মতো আর কোন কর্মীকে মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না।’ সংগঠনের প্রতিটি নেতাকর্মী দুই নেতার ওপর হতাশ হয়ে এখন তাকিয়ে আছেন প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দিকে। প্রিয় নেতা দ্রুত ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে সংগঠনটি রক্ষা করবেন বলে আশা করছেন সারাদেশের ছাত্রলীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী, সমর্থক। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হাত ধরে সম্মেলনের মাধ্যমে অনেকটা চমক নিয়েই দীর্ঘ ১০ মাসেরও বেশি সময় আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পদে আসেন দুই নেতা। একই অবস্থা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কমিটিরও। মেধাবী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্ব গঠনে ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত কঠোর যাচাই-বাছাইও হয়েছিল অসংখ্য আগ্রহী নেতার। তবে শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আসেন তারা আজও দিতে পারেননি পূর্ণাঙ্গ কমিটি অথচ কমিটির এ সঙ্কটের জন্য ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগকে মূল্য দিতে হয়েছে ডাকসু নির্বাচনে সভাপতির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। নেতাকর্মীদের আশ^স্ত করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ সময়ে অন্তত অর্ধশতবার বলেছেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই কমিটি হয়ে যাচ্ছে’। ডাকসু নির্বাচনের আগেও বলা হয়েছিল, ‘নির্বাচনের আগেই হতে পারে কমিটি’। আবার কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় ঢাবি ও মহানগর কমিটি গঠনও ঝুলে আছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কারা কারা স্থান পাচ্ছেন তা দেখেই সাধারণত ঢাবির কমিটি গঠন হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন না হওয়ায় সেটাও আটকে আছে। এসব বিষয়ে বাড়ছে অসন্তোষ। পরিস্থিতি এমন যে ইদানীং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনেও খুব একটা আসেন না কেন্দ্রীয় দুই নেতা বরং মধুর ক্যান্টিনে এখন সরব উপস্থিতি দেখা যায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের। এসব বিষয়েও নেতাদের ওপর কর্মীরা ক্ষুব্ধ। এর আগে ছাত্রলীগে বহু বছরের সিন্ডিকেটের দাপট, অনুপ্রবেশকারী, অপরাধীদের সদস্যপদ গ্রহণসহ নানা বিতর্কের মধ্যে গত বছর নির্বাচনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মাধ্যমে সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্ধারণের দাবি উঠেছিল। বিষয়টিতে ইতিবাচক সাড়াও দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন হয় গত বছরের ২৯ এপ্রিল। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের সম্মেলন হয় যথাক্রমে ২৫ ও ২৬ এপ্রিল। এরপর ১১ ও ১২ মে নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণে ছাত্রলীগের দুই দিনব্যাপী ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়। নির্বাচন না হলেও এবার ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের লক্ষ্যে আগ্রহীদের কঠোর ও ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া ছিল আলোচিত ঘটনা। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও নানা মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হয় নেতৃত্বে আসতে আগ্রহী প্রায় আড়াই শ’ নেতাকর্মীর। তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় আবেদন করেননি এমন নেতাকর্মীদেরও, যারা সংগঠনের নেতৃত্বে আসতে চান। মূলত তাদের প্রিয় নেতার হাত দিয়ে কমিটি হচ্ছে- এই আশায় অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এবার ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে আসতে আগ্রহী অনেক বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এমন অবস্থার মধ্যে গত ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি এবং গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই দিন আওয়ামী লীগ সভাপতির ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিও অনুমোদন করা হয়। কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয় সেদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি হয়েছেন সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। ঢাকা মহানগর-উত্তরের সভাপতি হয়েছেন মোঃ ইব্রাহিম এবং সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয়। ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি হয়েছেন মেহেদী হাসান, সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন জোবায়ের আহমেদ। এরপর থেকেই কেন্দ্রসহ চার ইউনিটির পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্য শুরু হয় অপেক্ষা। সেই থেকেই সবার প্রশ্ন, সিভি দিয়ে পরীক্ষা দিলাম কিন্তু ফল প্রকাশ হবে কবে? সবাই বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সক্রিয় হলে বহু আগেই দিতে পারতেন কমিটি। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহু আগেই আগ্রহী প্রার্থীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ করেছেন। যাচাই-বাছাই করে বহু আগেই প্রার্থীদের তালিকা করা হয়েছে। ফলে সেই তালিকা দেখেও দ্রুত কমিটি দেয়া সম্ভব ছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা যারা এখন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে আছেন তাদের অনেকেই বলছেন, খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও কয়েকবার ছাত্রলীগ নেতাদের দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তবুও ফল নেই বরং পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে বিলম্ব হওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঢাবিসহ দেশের উল্লেখযোগ্য ক্যাম্পাসগুলোয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের আগের মতো ক্যাম্পাসে না পাওয়া, আওয়ামী লীগের নতুন প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সভাপতি সেক্রেটারির জন্য আলাদা অফিস কক্ষ থাকার পরেও সেখানে কালেভদ্রে তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করে গেছে। ঢাবি ইউনিটির সঙ্গে সংগঠনের কাজে চরম সমন্বয়হীনতায় নষ্ট হচ্ছে সংগঠনের শৃঙ্খলা। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির সঙ্গে নেতাকর্মীদের যোগাযোগের অভাবও দূরত্ব বাড়াচ্ছে। ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা যিনি এখন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তিনি কমিটি ইস্যুতে বিব্রত। তিনি বলছিলেন, ‘আপা (সভাপতি শেখ হাসিনা) কয়েকবার ওদের বলেছে কমিটি গঠন করতে। কিন্তু ওরা আসলে সদস্য ভাগ-বাটোয়ারায় ব্যস্ত। সাবেক নেতা ও বর্তমান দুই নেতা তাদের নিজস্ব ভাগ-বাটোয়ারা মেলাতে পারছেন না। বিষয়টি তিনি আপা খেয়াল করছেন তাও ওরা বুঝছে না, নাকি স্পর্ধা দেখাচ্ছে তা বোঝার অপেক্ষায় আছি।’ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ সভাপতি মেহেদী হাসান রনি বলছিলেন, শুধু সভাপতি-সেক্রেটারিনির্ভর একটি কেন্দ্রীয় কমিটি দীর্ঘদিন এভাবে চলতে পারে না। যেসব কর্মী দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের সঙ্গে আছেন বিভিন্ন কমিটির অধীনে, তাদের নিয়ে সাংগঠনিক কমিটির মাধ্যমে সংগঠন শক্তিশালী করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না করে, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন না দিয়ে, শুধু সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে সংগঠন চললে তা ভাল দেখায় না। এতে সংগঠন শক্তিশালী হয় না। সংগঠন অনেকটা মানবদেহের মতো। বর্তমানে শুধু মাথা আছে, শরীরের আর কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না থাকার মতো। এছাড়া মাদকমুক্ত সংগঠন গড়ে তুলতে পদ প্রত্যাশীদের ড্রাগ টেস্ট করে কমিটি দিলে খুবই ভাল হয়। এবার ডাকসু নির্বাচনের আগেই সাধারণ নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন একাধিক সাবেক সহ-সভাপতিসহ অনেকে। তাদের এক সাবেক সহসভাপতি সোহান খান বলছিলেন, ছাত্রলীগের জবাবদিহিতার জায়গা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রিক একক আধিপত্য সংগঠনের অন্যান্য কর্মীকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে। এর বড় কারণ হচ্ছে কেন্দ্র ঢাবি, মহানগরের সম্মেলনের পর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও কোন কমিটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। যার প্রভাব জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগ কমিটি পর্যন্ত বিদ্যমান, নেতাকর্মীরা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। এখন কী বলছেন নেতারা ॥ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেছেন, আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়ার জন্য কাজ অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি আছে। কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কমিটি দিতে পারব। কেন্দ্র কী বলছে? কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসু জিএস গোলাম রাব্বানী আবারও বলেছেন, ‘সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। শুধু আপার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা করেই কমিটি ঘোষণা করব। কবে হতে পারে এই মাসেই দিতে চাই। দিতে পারলে খুশি হব। তবে পারা না গেলেও আগামী মাসের ২ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে অবশ্যই দিয়ে দেব।
×