ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংস্কার জরুরী

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৯ মার্চ ২০১৯

  চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংস্কার জরুরী

(শেষাংশ) লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিকভাবে একটি লক্ষ্য স্থির করি- ‘চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্পদ এবং জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে রোগীদের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।’ এ লক্ষ্যে সুপারিশ হলো - ১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ : যে কোন কাজ শুরুর আগে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা সঠিক করে নিতে হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক এবং অকার্যকর। বাস্তাবিক পক্ষে স্বাস্থ্য সচিব থেকে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক খুবই ব্যস্ত। তাদের পুরনো দায়িত্ব বণ্টন (Charter of Duties) এখন অবাস্তব। প্রতিটি কাজের যে মনিটরিং, সুপারভিশন এবং ফলোআপ করা দরকার এ ব্যবস্থায় সম্ভব নয় এবং এছাড়া কোন র্কাযক্রমই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। একই ব্যক্তির আবার বহু দায়িত্ব দেয়ায় এবং ধরে রাখার প্রবণতার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। যেমন একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, তিনিই ডিন, তিনিই বিভাগীয় প্রধান, তিনিই বিএমডিসির সদস্য এবং অনেক চিকিৎসক সমিতির নেতা। আবার রয়েছে প্রাইভেট প্রাকটিস এবং ক্লিনিকে ভর্তি রোগী দেখা- একটি কাজের জন্যই তাকে চব্বিশ ঘন্টা ব্যয় করার কথা। এ কাজগুলোর সুসম বন্টন হলে কাজের গতি এবং আউটপুট বাড়বে। বহুবার ভাবা হয়েছে প্রশাসনিক পদগুলোকে নন প্র্যাকটিসিং করার। স্বাস্থ্য প্রশাসকদের দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। লোকবলও পর্যাপ্ত নয়। প্রশাসকদের সহকর্মী বান্ধব এবং supportive হতে হবে। গ্রহণযোগ্য কর্মপরিবেশ এবং মানসিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য প্রশাসন কাঠামো পুর্ণমূল্যায়ন করে বাস্তব দায়িত্ব বন্টন এবং নিবীড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২. স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা (Health man power planning) গ্রহণ ; ৪৮ বছরের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোন স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কখনো কখনো হয়েছে তবুও তা বাস্তবায়ন হয়নি। একটি সময়পোযোগী- স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা করা সময়ের দাবি। কারণ, আমরা উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) কার্যক্রম শুরু করেছি। ৩. বাজেট : জাতীয় বাজেটের নূন্যতম দশভাগ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। এতে ক্ষতি হবে না। সুস্থ জনবল দেশের উন্নয়নে বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেট মাথাপিছু ৩২ ডলার, ভারতে ৬১ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭১০ ডলার এবং শ্রীলংকায় প্রায় ১০০০ ডলার। ৪. নিয়োগ এবং বদলি নীতিমালা : দেশে কোন সুর্নিদিষ্ট নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা নেই। এটিই তরুণ চিকিৎসকদের হতাশার অন্যতম কারন। তরুণ চিকিৎসকদের বদলির ধাপ এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সম্বলিত একটি কার্যকর Carrier Planning দরকার। তাহলেও কিছুটা হতাশা দূর হবে। দূরবর্তী বা দুর্গম চিকিৎসা কেন্দ্রের পদায়নের জন্য আলাদা আর্থিক incentive যুক্ত করা প্রয়োজন। ৫. বিএমডিসিকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হবে : প্রায় ১৫ বছর বিএমডিসি মামলাধীন এবং অকার্যকর ছিলো। বর্তমানে কিছুটা কার্যকর হয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নানা দুর্বলতায় নিমজ্জিত। চেয়ারম্যান পদে একজন সার্বক্ষণিক পেশার সিনিয়র অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দিলে যথাযথ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয় না। লোকবলের স্বল্পতাসহ রয়েছে নানা সমস্যা। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে এর সকল সমস্যা দ্রুত সমাধান করে সর্র্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ও মেডিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রম অনেক সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রিত হবে। ৬. বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা : দেশের বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন কার্যকর নীতিমালা নেই। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক- নার্স জনবল ও নিয়মিত বেতন কাঠামোসহ কার্যকর নীতিমালা থাকতে হবে যাতে চাকরিরত চিকিৎসক নার্স এবং অন্যান্য জনবল চাকরির নিশ্চয়তা পেতে পারে। বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সরকারীভাবে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। ৭. নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : প্রতিটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা হরতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ ফাঁড়ি বা পুলিশের বিশেষ স্কোয়াডের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসক আক্রমণ এবং হাসপাতালে ভাঙচুরের জন্য দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ৮. আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিন্যাস : কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা, যোগাযোগ করা বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমস্যা সমাধান করা বাস্তবমুখী নয়। প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো এবং ক্ষমতা প্রদান করে জেলা বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। ৯. ওষুধের মূল্য : বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অত্যন্ত গৌরবের। দেশের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশে^র ১৪৫টি দেশে রফতানি করছে। ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রয়োজনীয় জনবল প্রয়োজন। ওষুধের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওষুধের মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ১০. রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত স্বাস্থ্য প্রশাসন : স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। সচিবালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশাসন চিকিৎসক সংগঠনের প্রভাব মুক্ত থাকতে হবে যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও আইনানুগভাবে কাজ করতে পারে। এ বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। ১১. মেডিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) : একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য MIS খুবই প্রয়োজনীয়। দুঃখজনক হলো আমি স্বাস্থ্য অধিদফতরের MIS বিভাগের কাছে কোন তথ্য বা সহযোগিতা পায়নি অসংখ্য বার যোগাযোগ করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ অবগত আছেন। দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিষয়ক তথ্য অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয়। ১২. সুনির্দিষ্ট অভিযোগ-সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা : ঢালাওভাবে অভিযোগ না করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রশাসনকে সব সময়ই accomodative হতে হবে। সহকর্মীর মানসিক অবস্থা, ব্যক্তিগত সমস্যা বিবেচনায় রেখে সহকর্মীবান্ধব প্রশাসন সৃষ্টি করতে হবে। শুধু শাস্তি প্রদানের মধ্য দিয়েই বন্ধত্বপূর্ণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের, আন্তরিক পরিবেশ গড়ে ওঠে না। ১৩. পেশাজীবীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ : চিকিৎসকদের সঙ্গে সকল পেশার মানুষের রয়েছে হৃদ্ধতাপূর্ণ সম্পর্ক। সকল পেশাজীবী চিকিৎসকদের কাছে বন্ধুত্বের কারণেই বিশেষ সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু মাঝে মাঝে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বিশেষ করে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে। চিকিৎসা একটি জটিল এবং বিস্তৃত বিজ্ঞান। কষ্ট সাধ্য পাঁচ বছর সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের CORE KNOWLEDGE রপ্ত করতে হয়। এছাড়া কেউ চিকিৎসা শাস্ত্র বা চিকিৎসার ধরন সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারবে না। করলে সঠিক হবে না বরং বিভ্রান্তিকর হবে। একজন চিকিৎসক চাইলে যে কোন সাধারণ পেশায় যেতে পারে-যাচ্ছে। কিন্তু অন্য যে কোন সাধারণ বিষয়ের মানুষ কখনই চিকিৎসক হতে পারবে না। আমরা সকলেই এ দেশের সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন। পরস্পর বিরোধী অবস্থান পরিহার করে কিভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আস্থা অর্জন করে বোঝাপড়ার শক্ত ভিত স্থাপন করতে পারি- সকলের সেদিকেই মনোযোগী হওয়া দরকার তা হলেই অনেক সঙ্কট দূরীভূত হবে। আমরা কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারি না বা সম্ভব নয়। সে জন্য সুসম্পর্ক থাকুক অটুট এবং কার্যকর। ১৭৬২ ডলারের মাথাপিছু আয়ের এ দেশে, অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও সকলের সহযোগিতায় একটি স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পারস্পরিক বৈরিতা এবং দোষারোপ পরিহার করে সমস্যা চিহ্নিত করে বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। চিকিৎসক-নার্স-স¦াস্থ্য কর্র্মীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং হাসিমুখে সেবা দিতে হবে যেমন তেমনি রোগী এবং স্বজনদের থাকতে হবে শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সহযোগিতা এবং সহনশীলতা। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর পরবর্র্তী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের পূর্বেই ওনার দিকনির্দেশনার সমস্যা সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী যেন সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরতে পারে মন্ত্রণালয় থেকে। লেখক : সাবেক উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×