ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে খুন হওয়া যুবকের কথা

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে খুন হওয়া যুবকের কথা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কথায় বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। প্রবাদটি আরও একবার সত্য প্রমাণ হয়েছে রাসেল নামের এক নিরীহ নিরপরাধ যুবক গ্রাম থেকে চাকরির সন্ধানে ঢাকায় এসে নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর। গ্রামে থাকার সময় রাসেল নামের ওই যুবকের সঙ্গে ঢাকা থেকে যাওয়া সমবয়সী যুবক সজলের পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে সখ্য। সজল রাসেলদের গ্রামে বিয়ে করেছিল। শ্বশুরবাড়ি এলাকার সবাই জানত সজল ঢাকায় ভাল চাকরি করে। সখ্যের পর রাসেল তার বন্ধু সজলের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিল চাকরির জন্য। পরে জানতে পারে সজল ইয়াবাসেবী। একদিন ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে খুন হতে হয় নিরাপরাধ গ্রামের সহজ সরল যুবক রাসেলকে। এ যেন সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। প্রায় চার বছর পর ক্লুলেস রাসেল হত্যা মামলার দুই আসামি গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বেরিয়ে এসেছে খুনের লোমহর্ষক কাহিনী। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত সেই সুইচগিয়ার চাকু দুটিও শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বরত অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনাটির সূত্রপাত হয় ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর। রাজধানীর কদমতলী থানায় রাসেল (২২) নামে এক যুবক খুনের ঘটনায় মামলা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে কোন আসামি শনাক্ত না হওয়ায় পুলিশ আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। মামলার বাদী রাসেলের মা রাশিলা বেগম (৪০) আদালতে না রাজি আবেদন দেন। আদালত মামলাটির তদন্তভার ২০১৭ সালে পিবিআইকে দেয়। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলছিলেন, আমরাও মামলাটির মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এজন্য মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ হিসেবে পরিচিত এসআই মোঃ আল-আমিন শেখকে দায়িত্ব দেই। সার্বিক সহযোগিতায় তদন্তকারী কর্মকর্তা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অনুসন্ধানে খুনীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হন। অবশেষে গত ৯ ফেব্রুয়ারি খুনী সজল ওরফে পিচ্চি সজলকে (২২) বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানার আমতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য মোতাবেক একইদিন মোঃ হোসেন বাবু ওরফে হুন্ডা বাবুকে (২৪) ঢাকার শ্যামপুর থানাধীন হাজীগেট ব্যাংক কলোনি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত সেই দুটি চাকু উদ্ধার হয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রাসেল হত্যার চাঞ্চল্যকর কাহিনী। ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলছিলেন, রাসেল গ্রামের ছেলে। বাড়ি খুলনা জেলার রূপসা থানাধীন শিরগতি গ্রামে। পিতার নাম জলিল হাওলাদার। গ্রামেই থাকত। অভাবের সংসার। তাই চাকরি খুঁজছিল। গ্রামে থাকার সময় পাশের বাড়িতে বিয়ে করা সজলের (গ্রেফতারকৃত খুনী) সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে সখ্য। সজল ঢাকায় ভাল চাকরি করত বলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলত। সজল নিজেও বলত। তাই রাসেল অভাবী পিতামাতার কষ্টে জমানো ৫ হাজার টাকা নিয়ে খুন হওয়ার মাস খানেক আগে সজলের সঙ্গে ঢাকায় আসে। ঢাকায় সজলের সঙ্গেই শ্যামপুরের পশ্চিম জুরাইনের তুলাবাগিচার ৪৫ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতে থাকে। আর চাকরি খুঁজতে থাকে। ঢাকায় একত্রে বসবাস করার সুবাদে রাসেল জানতে পারে সজল ইয়াবায় আসক্ত। তারপরেও আর কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে সজলের সঙ্গেই থেকে যায়। সজলের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরতে যায়। এভাবেই আস্তে আস্তে সজল তাকে ইয়াবা সেবন শেখায়। রাসেল শুধু সজলের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। ভেতরের খবর কিছুই জানে না। প্রকৃতপক্ষে ওইসময় সজলের সঙ্গে ইয়াবা সম্রাজ্ঞী পিংকীর ঘনিষ্ঠতা চলছিল। আর পিংকীর সঙ্গে পারভেজ নামের আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর দ্বন্দ্ব আছে। দুটি চক্রটি কদমতলী ও শ্যামপুর থানা এলাকার মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। ওই বিরোধের জেরধরে পিংকী পারভেজকে খুন করার জন্য হুন্ডা বাবু ও সজলকে ভাড়া করে। পরিকল্পনা মোতাবেক সজল, জুয়েল, আল-আমিন ও গ্রাম থেকে আসা রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে কদমতলীর একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়ে ইয়াবা সেবন করতে থাকে। পরিকল্পনা মোতাবেক হুন্ডা বাবুকে দিয়ে কৌশলে পারভেজকে ইয়াবা সেবনের জায়গায় নিয়ে যায়। অন্ধকার ঘরে তারা মোবাইল ফোনের টর্চ লাইট জ্বেলে ইয়াবা সেবন করতে থাকে। এক পর্যায়ে সজল ও হুন্ডা বাবু কোমরে থাকা সুইচগিয়ার চাকু দিয়ে পারভেজের মাথায় আঘাত করে। এ সময় হুড়োহুড়িতে মোবাইল ফোন হাত থেকে ছিটকে পড়ে রুম অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময় যে যার যার মতো এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ওই সময় অন্ধকারে রাসেলের পেটে ও পাঁজরে চাকুর আঘাত লাগে। চিৎকার শুনে জনতা আহত অবস্থায় পারভেজ ও রাসেলকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রায় চারদিন পর নিদারুণ কষ্টের পর হাসপাতালেই গ্রাম থেকে চাকরির জন্য আসা সহজ সরল যুবক রাসেলের মৃত্যু হয়। ডিআইজি বলছিলেন, ঘটনা এখানেই শেষ নয়। থানা পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে খুনীরা শনাক্ত না হওয়ায় তারা যে যার যার মতো বিয়ে করে ব্যবসা করে সংসার করছিল। তাদের যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে এজন্য তারা রাসেলকে যে বাসায় ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, সেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিল। আর এলাকায় রাসেল ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে বলে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। কিন্তু বিধি বাম। শেষ রক্ষা হলো না খুনীদের। কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। শেষ পর্যন্ত তাই সত্যি হয়েছে।
×