ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তিকে চাষী পর্যায়ে নিয়ে যান ॥ কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক

অল্প জমি ও মাটি ছাড়া সবজি, ফুল, ফল উৎপাদন

প্রকাশিত: ১০:০৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 অল্প জমি ও মাটি ছাড়া সবজি, ফুল, ফল উৎপাদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাটি ছাড়াও বিভিন্নভাবে নানা ধরনের সবজি, ফুল বা ফল উৎপাদন করা যায়। এতে একদিকে খরচ কমে আবার বাঁচে সময়ও। সেই সঙ্গে অল্প জায়গায় চাষাবাদের মাধ্যমে অধিক ফলনও উৎপাদন করা যায়। কিভাবে অল্প জমি বা কংক্রিট জায়গায় উৎপাদন হবে ফসল তারই নানা প্রযুক্তি তুলে ধরছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)। শহরের ছাদে বা পতিত ভূমিতে যাতে সারাবছর চাষাবাদ করা যায় এজন্য উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিষয়ে জনগণের মাঝে ধারণা দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সর্ববৃহৎ বহুবিধ ফসলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ২০৮টিরও বেশি ফসলের ৫৩১টি উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিডসহ), রোগ প্রতিরোধক্ষম ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেছে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ৫০৫টি প্রযুক্তিসহ মোট ১ হাজার ৩৬টিরও বেশি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রবিবার গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে দুই দিনব্যাপী ‘বারি প্রযুক্তি প্রদর্শনী-২০১৯’ উদ্বোধন করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, নানা ধরনের প্রযুক্তি দেখানো হচ্ছে। যার একটি ভার্টিকেল হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ। এই পদ্ধতি নিয়ে উদ্যানতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এইচ এম খায়রুল মাজেদ বলেন, এটি একটি আনুভূমিক স্তর উলম্বভাবে স্বল্প জায়গায় একাধিক ফসল উৎপাদনের কৌশল। এই পদ্ধতির সুবিধা নিয়ে বলেন, ৪ ফিট লম্বা ৩ ফিট উচ্চতা জায়গায় কমপক্ষে ১৮টি গাছ লাগানো যাবে। এতে অধিকসংখ্যক গাছ রোপণ করা যায়। অর্থাৎ প্রতি একরে ৩ থেকে ৮ গুণ বেশি গাছ লাগানো যায়। এতে ফসল উৎপাদনে পানি, শ্রম কিংবা লেবার খরচ সবই কম লাগে। চাষ নিয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, এই পদ্ধতিতে পাইপের দু’পাশ বন্ধ করে পাইপে নির্দিষ্ট অন্তর অন্তর ছিদ্র করতে হবে। ৬ ফুট পাইপে মোট বিশ লিটার পানিতে মাত্র ৩০ টাকার রাসায়নিক দ্রবণ ব্যবহার করতে হয়। আরেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ২০০৬ সাল থেকে এটি নিয়ে কাজ শুরু হয়। এই পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম, লেটুস, স্ট্রবেরি, টমেটো, কাঁচামরিচ, বেগুনসহ অন্যান্য ফসলও চাষ সম্ভব। এছাড়াও নারিকেলের আঁশের গুড়ায় কিভাবে মিষ্টি আলু, লেবু, মরিচসহ অন্য কিছু চাষাবাদ করা যায় তাও দেখানো হয়। এছাড়াও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন সবজি ফুল চাষ বিষয়ে ধারণা দেয়া হচ্ছে প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে। এতে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ট্রের ওপর পানি রাখা আর পানির ওপর ককসিট দেয়া হয়েছে। ফলে ককসিটের ওপর দিয়ে বেড়ে উঠছে নানা ধরনের গাছ। জানা যায়, বালতিতেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। আর ট্রের মধ্যে পরিমাণ মতো পানি দিতে হবে। পানিতে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান দ্রবণ দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে লেটুস চাষ নিয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে অপ্রচলিত সবজি হলেও দিন দিন শহরে এর জনপ্রিয়তা অনেক বাড়ছে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ২০ দিন পর লেটুস সংগ্রহ করা যেতে পারে। আর শীত মৌসুমে একটি ট্রে হতে ২-৩ বার লেটুস উৎপাদন করা যায়। একই পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করলে হেক্টর প্রতি ১২০-১৩০ টন ফলন সম্ভব যেখানে মাটিতে করলে হেক্টর প্রতি ফলন হয় ৯০-৯৫ টন। কর্মকর্তারা বলেন, সব ধরনের সবজির ক্ষেত্রেই ফলন বাড়বে এবং রোগবাইল কম। আগত দর্শনার্থীরা এসব প্রযুক্তি বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিতেও দেখা যায়। এছাড়াও বারি গুঁটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র প্রদর্শন, কাঁঠালের খোসা ছাড়ানো যন্ত্র, সোলার পাম্পের মাধ্যমে সহজভাবে সেচসহ অন্যান্য প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে আলু, ডাল, সরিষা, বিভিন্ন সবজিসহ নানা জাত নিয়ে ধারণা দেয়া হয়। এছাড়াও লবণাক্ত অঞ্চলে বা অন্যান্য অঞ্চলে কোন ফসল ভাল হবে উৎপাদনে সে বিষয়েও ধারণা দিচ্ছেন। এদিকে, ‘বারি প্রযুক্তি প্রদর্শনী-২০১৯’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব প্রযুক্তি দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানোর কথা বলেন বক্তারা। বারির মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। সংসদ সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএআরআই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (অব) ও ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, সেবা ও সরবরাহ বিভাগের পরিচালক ড. মদন গোপাল সাহা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন গবেষণা পরিচালক ড. মোঃ আব্দুল ওহাব। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘কৃষি প্রযুক্তি হাতবই ২০১৯’-এর মোড়ক উšে§াচন করা হয়। এছাড়া প্রদর্শনী উদ্বোধনের আগে বারি ক্যাম্পাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল উদ্বোধন ও গাছের চারা রোপণ করেন মন্ত্রী। ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর তা যদি মাঠ ও চাষী পর্যায়ে না যায় তাহলে উদ্ভাবনে কোন লাভ নেই। এ দায়িত্বটি কৃষি বিজ্ঞানীদেরকেই নিতে হবে। উৎপাদিত প্রযুক্তির কতটি চাষী পর্যায়ে গিয়েছে তা দেখা উচিত। ভুট্টা এক সময় দেশের কোন ফসল ছিল না, বর্তমানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলে পরিণত হয়েছ। কৃষি বিজ্ঞানীদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আগামী তিন বছর পর এক টন ভুট্টাও আমদানি করব না। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, আগে কৃষি বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ও গবেষক হতে চাইতেন। বর্তমানে তারা চান ব্যাংক ও অন্যান্য পেশায় যেতে। এটি অনুধাবন করতে হবে। এ ধারণা পাল্টাতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ৪০ লাখ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করত। বর্তমানে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টনে। দেশে আগে ৫ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হতো, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখ মেট্রিক টনে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম, সাফল্য, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনার ওপর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা করেন পরিচালক (তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্র) ড. মোঃ লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বারি দানা ফসল, কন্দাল ফসল, তেল ফসল, ডাল ফসল, সবজি, ফুল ও ফল, মসলা ফসল ইত্যাদির উচ্চ ফলনশীল জাত ও এসব জাতের উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তা সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্মী ও কৃষকের নিকট হস্তান্তরের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে আসছে। ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, বারি জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি ফসল, পানি, সার ও মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকা-মাকড় দমন, জীব প্রযুক্তি, হাইড্রোপোনিক, আইপিএমসহ ফসল, মৃত্তিকা, পানি, রোগ ও পোকা-মাকড় দমন এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ সকল প্রযুক্তি প্রতিকূল পরিবেশে বিশেষ করে লবণাক্ত, খরা, জলাবদ্ধতা, পাহাড়ী এলাকা ও চরাঞ্চলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। বিএআরআই কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে উদ্ভাবিত এ সকল প্রযুক্তি প্রদর্শিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ও কিষানিসহ প্রায় ৪০০ জন অংশগ্রহণ করবেন।
×