ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

চক্রের ৪৬ সদস্য গ্রেফতার

দেড় বছরের সাঁড়াশি অভিযানে ধসে গেছে প্রশ্নফাঁস চক্র

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দেড় বছরের সাঁড়াশি অভিযানে ধসে গেছে প্রশ্নফাঁস চক্র

গাফফার খান চৌধুরী ॥ টানা দেড় বছরের সাঁড়াশি অভিযানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত দুটি চক্রকেই পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি নজরদারির কারণে বিদায়ী বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন ঘটনা ঘটেনি। এমনকি আগামীকাল শনিবার থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের তেমন কোন আশঙ্কা নেই। সম্প্রতি চালানো অভিযানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ৪৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অবৈধ ৩০ কোটি টাকা উপার্জনের তথ্য মিলেছে। এ নিয়ে গত দেড় বছরের টানা অভিযানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যক্তি সিআইডির হাতে গ্রেফতার হলো। এদের মধ্যে শিক্ষক, ছাত্র, সরকারী কর্মকর্তা, প্রেস মালিক ও কর্মচারীও আছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সদর দফতরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানালেন সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ হিমায়েত হোসেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ টানা কয়েক দিনের অভিযানে ৪৬ জনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়েছে। পরে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আদ্যোপান্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মূলত প্রথম প্রথম যে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপা হতো, সেই প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো। প্রেসের ওপর নজরদারি আর ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর প্রেসের মালিক, কর্মচারী থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর দ্বিতীয় চক্রটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে শুরু করে। তারা অত্যাধুনিক ডিভাইজ দিয়ে প্রশ্নপত্রের সমাধানের মাধ্যমে তা পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে ফাঁস করা শুরু করে। প্রেসের মাধ্যমে যেভাবে সর্বপ্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়ে ॥ ২০১৭ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের চিত্র দিনকে দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকে। তারই প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলে অভিযান চালানো হয়। ম্যানুয়াল অর্থাৎ প্রেসের মাধ্যমে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত রানা ও মামুন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে গ্রেফতার হয়। এদের দেয়া তথ্য মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার হল থেকে গ্রেফতার করা হয় রাফিকে। এদের দেয়া তথ্য মোতাবেক প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সাত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র পেয়ে যেত। যার মাস্টারমাইন্ড নাটোর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এসামী, প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, তার আত্মীয় সাইফুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বনি ইসরাইল ও মারুফ হাসানসহ ২৮ জন। পরে এদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সংঘবদ্ধ চক্রটি ২০১৫ ও ২০১৬ সালে প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁস করে এবং সাভারের একটি বাসায় আগের রাতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পড়াত। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যেত। তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিত চক্রটি। যেভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ॥ চক্রটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে যেসব শিক্ষক ও কর্মচারী প্রশ্নপত্র নিয়ে যায়, তাদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। ওইসব শিক্ষক বা কর্মচারীরা আধুনিক মোবাইল দিয়ে প্রশ্নপত্রে ছবি তুলে তা বাইরে চক্রটির কাছে পাঠিয়ে দিত। চক্রটি প্রশ্নের সমাধান করত। আর যেসব পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চক্রটির যোগাযোগ থাকত, তাদের কানের ভেতরে বা শার্টের কলারের নিচে বা কানের কাছে চুলের তলায় লুকিয়ে রাখার মতো একটি গোপন যন্ত্র বসিয়ে দিত। বাইর থেকে ওইসব পত্রের সমাধান করা উত্তর বলত। তা শুনে শুনে পরীক্ষার্থী লিখত। এই চক্রটির মাস্টারমাইন্ড বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস। তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ইব্রাহিম মোল্যা, বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, আইয়ুব আলী বাঁধনসহ ৯ জন। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্র ॥ পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর অগ্রণী স্কুলের শিক্ষক গোলাম মোহাম্মদ বাবুল, অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন মজুমদার এবং মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম গ্রেফতার হয়। একই অভিযোগে ধানম-ি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম এবং পিয়ন হাসমত আলী শিকদার গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার কয়েকটি প্রশ্নপত্র ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে সহায়তা করার জন্য পাওয়া টাকার মধ্যে ৬০ হাজার টাকাও উদ্ধার হয়। চক্রটির ছয়জন হোতার মধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হাফিজুর রহমান হাফিজ এবং ব্যবসায়ী মাসুদ রহমান তাজুল ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। সর্বশেষ তারাও গ্রেফতার হয়েছে। সর্বশেষ অভিযানে এদের সহযোগী অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান সাইদ, তাজুলের প্রধান সহযোগী ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অসিম বিশ্বাস, বেসরকারী গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিমন হোসেন এবং ঢাকা কলেজের পিয়ন মোশারফ হোসেন মুসা এবং হাফিজুর রহমান হাফিজের ভাই আব্দুর রহমান রমিজ গ্রেফতার হয়। এদের মধ্যে অসিম বিশ্বাস মুম্বাই থেকে পরীক্ষায় জালিয়াতিতে ব্যবহৃত কয়েক শ’ ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমদানি করে। জালিয়াতদের কোটি কোটি টাকা কামানোর তথ্য ॥ অলিপ কুমার বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে দুই কোটি টাকা রোজগার করেছে। তার সহযোগী ইব্রাহিম, হাফিজ, মোস্তফা, তাজুল ও বাঁধন বিসিএসসহ সব চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার জালিয়াতির মাধ্যমে ২০ কোটি রোজগার করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন ॥ জালিয়াত চক্রের মধ্যে ইব্রাহিম বিলাসী জীবনযাপন করত। সে পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। সে ৩৬ লাখ টাকা দামের গাড়িতে যাতায়াত করে। জালিয়াতির টাকায় খুলনার মুজগুন্নী এলাকায় সাড়ে ছয় শতাংশ জমির ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করেছে। নড়াইলে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছে। সে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা করত। এছাড়া হাফিজের ব্যাংকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে। মোল্লা নজরুলের দাবি, নজরদারি আর অভিযানের কারণে গত বছর প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার তেমন কোন সম্ভবনা নেই। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ডিআইজি শাহ আলম ও সিআইডির লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া সেলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার শারমিন জাহানসহ উর্ধতন সিআইডি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×