ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই গুরুত্ব দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই গুরুত্ব দিতে হবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। মন্ত্রীসভায় নতুনদের জয়জয়কার। সিনিয়র অনেক নেতাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মন্ত্রিসভায় মহাজোটভুক্ত কাউকে রাখা হয়নি। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসে দায়িত্ব পালন করবে। সেই লক্ষ্যে দলীয় প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা। উপনেতা হয়েছেন জিএম কাদের। ফলে জাতীয় পার্টির কেউ সরকারে তথা মন্ত্রিসভায় নেই। মহাজোটভুক্ত অন্য দলগুলোর প্রতিনিধি সকলে মিলে সংসদ প্রাণবন্ত রাখবেন এটা প্রত্যাশা করি। তবে ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী ৮ জন (দু’জন গণফোরাম, ছয়জন বিএনপির) এখনও শপথ নেননি। তাদের অবস্থান কি হবে তা আগামী দিনগুলোতে দেখা যাবে। সরকারের কাছে এদেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে একটি বিরোধী দল কাম্য। কেননা বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন বিল এবং প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের প্রাণও বলা হয়। কিন্তু এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে সব সময় সংসদে থাকতে হবে। অর্থাৎ সরকারের বাইরে সংসদে যে দলই থাকবে কেবল তারা বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হবে- এমন ধারণ সঠিক নয়। বিরোধী দল সংসদের বাইরে অবস্থান করেও ভূমিকা পালন করতে পারে। সংসদের বাইরে অবস্থান করেও তারা জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের গঠনমূলক সমালোচনা করবে এবং গণমানুষের বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করবে। অর্থাৎ সরকারের নানা ইস্যুতে সংসদের বাইরে থেকেও তারা বক্তব্য রাখতে পারবে। এখন কেউ যদি মনে করে সংখ্যা বিবেচনায় সংসদে বিরোধী দলের জোরালো অবস্থান নেই সেক্ষেত্রে আমি মনে করি এমন ধারণা সঠিক নয়। তারা কেবল সংসদে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখতে পারবে না, কিন্তু সংসদের বাইরে তারা ঠিকই বক্তব্য রাখবে। অতীতে আমরা দেখেছি খুব কম সংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায়। দুই থেকে তিনজন সংসদ সদস্য নিয়েও বিরোধী দল অতীতে দেখা গেছে। যেমন- বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি একাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন। অতীতে আমরা দেখেছি অনেক বড় বিরোধী দল যাদের সংসদ সদস্য সংখ্যা শতাধিক, তারা জাতীয় সংসদে যাননি এবং কথা বলেননি। অনেক সংখ্যক সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল অনবরত সংসদ বর্জন করেছে এমন নজিরও রয়েছে। কাজেই বিরোধী দলকে সব সময় সংসদে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। আওয়ামী লীগের সংসদীয় সভায় শেখ হাসিনাকে নেতা নির্বাচন করা হয়। রাষ্ট্রপতি তাকে সরকার গঠন করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার আলোকে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, যেখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। কাজ করার দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ এটা যেমন সত্য, তেমনি আমি মনে করি এগুলোর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা। যারা নতুন চিন্তা করেন এমন সৃজনশীল নেতাদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসা হয়েছে। নতুনদের অবস্থান বেশি হলেও কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র ব্যক্তি এবং অভিজ্ঞদের স্থান দেয়া হয়েছে। এই মন্ত্রিসভা যেন আমলামন্ত্র নির্ভরশীল না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমলারা যা বলবেন সেই অনুযায়ী মন্ত্রী কাজ করবেন তা যেন না হয়। বরং মন্ত্রী তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় জনতার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে দূরদৃষ্টি নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্নপূরণে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। তা যেন বাস্তবায়িত হয় সেক্ষেত্রে নতুন যারা মন্ত্রী হলেন তাদের নতুন চিন্তা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। বিগত দিনে আমরা এমন অনেক মন্ত্রীকে দেখেছি যারা কেবল রুটিনওয়ার্ক করতেন। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। এক্ষেত্রে সরকারকে প্রথম গুরুত্ব দেয়া উচিত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমাদের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে, এখন দরকার এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল ডিভাইডেন্ড বলছি, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর এর মাধ্যমে আমাদের টার্গেট ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে ধনী দেশ হবে। এই সব টার্গেট অর্জন করার জন্য আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশে প্রচুর লোক বেকার। তারা কাজ পাচ্ছে না। আরেকদিকে আমাদের দেশের কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে। দেশে এখন কয়েক লাখ বিদেশী দক্ষ লোক কাজ করছেন। আমাদের যারা মেধাবী তরুণ তাদের জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু দক্ষতার বড় অভাব। অর্থাৎ তারা কাজটি সঠিকভাবে করার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাত্ত্বিকভাবে তারা খুব ভাল করবে। কিন্তু ব্যবহারিকভাবে কাজ করার জন্য তাদের যে দক্ষতার দরকার ছিল সেই শিক্ষা আমাদের তরুণরা পায়নি। আমাদের কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব কাজ তরুণরা করবে সেইসব কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এজন্য অবিলম্বে আমাদের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সত্য, কিন্তু সেইসঙ্গে শিক্ষার মানগত প্রসারও ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় থাকার পরও আমাদের যে পরিমাণে দক্ষতার উন্নয়ন করা দরকার তা হয়নি। সেজন্য কারিগরি, প্রকৌশল প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের যেতে হবে। আশা করি আগামী ৫ বছরের মধ্যে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ নিশ্চিত হবে। দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স দেখানোর পরও দুর্নীতি শেষ হচ্ছে না। বরং দুর্নীতি কিছু থেকেই যাবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যখন উন্নয়নশীল ধারায় থাকে তখন রাষ্ট্র কতগুলো স্তর অতিক্রম করে। তার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে দুর্নীতি। যতটা সম্ভব দুনীতি মিনিমাম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আগামী ১০০ দিনের মধ্যে সরকারকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিষয় দৃশ্যমান করতে হবে তা হলো দুর্নীতিক কোনভাবেই প্রশ্রয় না দেয়া। আর এর চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুর্নীতি করে মানুষ যেসব টাকা উপার্জন করেছে তা যেন বিদেশে যেতে না পারে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতিবাজরা টাকা বিদেশ পাচার করে। দুর্নীতি করেও অর্থ যদি দেশে রাখত, ব্যাংকে কিংবা বিনিয়োগ করত তাহলে সুফল পাওয়া যেত। কোন না কোনভাবে দুর্নীতির টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুর্নীতির টাকা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিভিন্ন কায়দায় মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে পাচার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ট্যাক্স নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দুর্নীতির ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। আর একটি সমস্যা হচ্ছে, যে হারে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, গড় আয়ু বাড়ছে, কিন্তু সে হারে ধনী-দরিদ্রের সমতা বাড়ছে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি দিক ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সমতা আনয়ন। বাংলাদেশ একটি সাম্যের দেশ হবে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার অবশ্যই শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, সামাজিক নিরাপত্তার যে নেটওয়ার্ক আছে তা আরও জোরালো করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন- কোন মানুষ গৃহহারা থাকবে না, না খেয়ে থাকবে না, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে না তার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয় আরও জোরালো করতে হবে। এ জন্য অর্থ সংস্থানের লক্ষ্যে সবাইকে ট্যাক্সের নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৩০ লাখোর টিন নম্বর আছে। তার চেয়েও দুঃখজনক ২০ লাখের কম মানুষ ট্যাক্স দেয়। এমনটি হতেই পারে না। আমাদের দেশে সকল করযোগ্য লোককে করের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×