ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব দেখেছে ২০০১ ও ২০১৮-এর নির্বাচন পরবর্তী পরিবর্তন

‘প্রতিহিংসার রাজনীতি বিশ্বাস করেন না শেখ হাসিনা’

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

‘প্রতিহিংসার রাজনীতি বিশ্বাস করেন না শেখ হাসিনা’

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ‘সে এক দুঃসহ স্মৃতি। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী হায়েনাদের পিছু ফেলে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরেরদিন সকাল থেকে বিভিন্ন দলে বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডাররা বিভক্তি হয়ে গ্রামে গ্রামে নারকীয় তা-ব চালিয়েছিল। তাদের মূল টার্গেট ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা। ওইসব সম্প্রদায়ের তরুণী, যুবতী ও সুন্দরী গৃহবধূদের সম্ভ্রমহানি করেছে চারদলীয় জোটের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। আর এবার ২০০১ সালের সেই চিহ্নিত বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও কোথাও টুঁ শব্দ পর্যন্ত হয়নি। বিশ্ববাসী আজ দেখছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতি বিশ্বাস করেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এসব অঞ্চলের নৌকার সমর্থক ভোটারদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কোটালীপাড়ার রামশীলে আশ্রয় নিতে হলেও সদ্যসমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও জামায়াতের সেইসব সন্ত্রাসীরা নির্বাচনের শুরু থেকে অদ্যাবধি নির্বিঘেœ নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। কথাগুলো বলছিলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি ও জামায়াতের চারদলীয় জোট সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার বরিশাল-১ আসনের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু। সেইদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরেরদিন আমার গ্রামের বাড়ি বিল্লগ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বিএনপির সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এ খবর পেয়ে আমাদের বাড়িতে হামলাকারী সন্ত্রাসীরা আসার আগেই বাড়ির অন্য সদস্যদের নিরাপদস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে আমি পালিয়ে রামশীলের উদ্দেশে রওয়ানা করি। পথিমধ্যে বিএনপির অপর এক গ্রুপের কাছে আমি ধরা পড়ে যাই। ওইসময় আমার বাবা কালিয়া দমন গুহ গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ অপরাধে ওইদিন সন্ত্রাসীরা আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে পানির জন্য আমি চিৎকার করতে থাকি। হামলাকারী এক সন্ত্রাসী আমার সামনে বসেই একটি পাত্রে প্র¯্রাব করে পানির পরিবর্তে আমাকে প্র¯্রাব পান করতে দেয়। সেদিন সেই প্র¯্রাব পান করেই আমি পানির পিপাসা মিটিয়েছি। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা আমাকে বেঁধে রেখে আমাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। এছাড়া বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা প্রতিবেশী এক গৃহবধূকে ৫/৬ জন সন্ত্রাসীরা গণধর্ষণ করে। গৌরনদীর চাঁদশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষ্ণ কান্ত দে বলেন, নির্বাচনের পরেরদিন সকাল থেকে বিএনপির সন্ত্রাসীদের নারকীয় তা-বের এক পর্যায়ে নিজ গ্রামে আত্মগোপনে থেকে পরেরদিন বোরকা পরে আমি ও আমার ছোট ভাই পালিয়ে পার্শ্ববর্তী রামশীলে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। সূত্রমতে, ২০০১ সালে সারাদেশে নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যারমধ্যে বরিশাল-১ আসনের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার আওয়ামী সমর্থিত নেতাকর্মীসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের নির্যাতনের নির্মম কাহিনী ছিল বিশ্বব্যাপী আলোচিত। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে হলেও ওই সময়কার নির্মম ঘটনার দায় স্বীকার করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তৎকালীন বরিশাল-১ আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত পরাজিত প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপন। সূত্রমতে, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ধানডোবা গ্রামের ৩০টি, বিল্লগ্রামের ২৫টি, চাঁদশী গ্রামের ২০টি, খাঞ্জাপুর গ্রামের ১৫টি, ইল্লা গ্রামের পাঁচটি, গেরাকুল গ্রামের পাঁচটি ও আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ৫০টি, রামানন্দের আঁক গ্রামের ২৫টি, বাহাদুরপুর গ্রামের ৩০টি, বাকাল গ্রামের ২৫টি, পতিহার গ্রামের ৩০টিসহ কয়েকশত পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এছাড়া জোট ক্যাডারদের হিং¯্র থাবা থেকে এসব এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের তরুণী, যুবতী ও গৃহবধূদের রক্ষা করতে অধিকাংশ পরিবার গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যারা বাড়িতে ছিলেন বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্য পরিবারের সদস্যরা রাতের আঁধারে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে নির্জন পুকুর কিংবা দীঘির মাঝে রেখেছিলেন। তার পরেও অসংখ্য নারী তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেননি বিএনপি ও জামায়াত ক্যাডারদের লালসার হাত থেকে। ২০০১ সালে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আগৈলঝাড়ার বাশাইলের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মোল্লাকে প্রকাশ্যে অপহরণ করে হত্যা করে। এছাড়া সরকারী গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বুলেটকে গৌরনদী বন্দরে বসে প্রকাশ্য দিবালোকে ইট দিয়ে পিটিয়ে ও বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার ছাত্রলীগ নেতা মাসুম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করে। ওইসময় দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় নির্যাতনের ঘটনা ধারাবাহিক প্রচারে জোট সরকার শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও থানায় কোনো মামলা করতে পারেনি নির্যাতিতরা। বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করা আগৈলঝাড়া উপজেলার সুতারবাড়ি গ্রামের সঞ্জীব জানান, নির্বাচনের পর তার বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। একপর্যায়ে তাকে ও পরিবারের নারী ও শিশুদের গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে আহত করে। ইল্লা গ্রামের নির্যাতিত প্রণব রঞ্জন দত্ত বাবু জানান, বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে কুপিয়ে জখম করে বাড়িতে লুটপাট চালায়। হামলাকারীরা তাদের বাড়ির মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ করেছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শুরু থেকে অদ্যাবধি জেলার কোথাও নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতিকে বিশ্বাস করেন না। তাই তার কঠোর নির্দেশনা থাকায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নির্বাচনের আগেই সতর্ক করে দেয়ায় কোথাও নির্বাচনী সহিংসতার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি আর ঘটবেও না।
×