ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও স্রোতের বিপরীতে বামজোট

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

 শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও স্রোতের বিপরীতে বামজোট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও এবারও স্রোতের বিপরীতে হাটল বাম দলগুলো। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বাম জোটের নেতারা বলেছেন, ভুয়া ভোটের ভুয়া নির্বাচন হয়েছে। ভোটের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কয়েকদফা বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া জানান বাম দল এবং জোটের নেতারা। রবিবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম এক বিবৃতিতে সারাদেশে সিপিবি, বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী, এজেন্ট, নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, হুমকির তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, নওগাঁয় সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাঃ ফজলুর রহমানের গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে ও দলীয় লোকজন ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। চারজন নেতাকর্মীকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। ঢাকার মিরপুর-১৪ আসনের প্রার্থী ডাঃ সাজেদুল হক রুবেলের এজেন্টের ওপর হামলা ও দলীয় কর্মীদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোও সরকারী দলের লোকজন ভেঙ্গে ফেলে। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, এছাড়াও নেত্রকোনা, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, বরিশালসহ প্রভৃতি স্থানে সিপিবি’র প্রার্থী ও এজেন্টদের ওপর হুমকি প্রদর্শন এবং নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল করে নেয়া। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সরকারী দলের পক্ষ থেকে আগে থেকেই আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল। অনেক জায়গায় গত রাতেই নৌকা মার্কায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ভোট কেন্দ্রে না যেতে বিভিন্ন এলাকায় হুমকি দেয়া, এজেন্টদের কেন্দ্রে না যেতে হুমকি প্রদান ও যারা গিয়েছিল তাদের বের করে দেয়া, অসংখ্য কেন্দ্র দখল করে নেয়া, এজেন্টের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনকে হাস্যকর নির্বাচনে পরিণত করেছে। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক ভোট কেন্দ্রে ‘ভোটার আছে, ব্যালট নেই’- এমন ঘটনাও ঘটেছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে দেয়ার পর ব্যালট না দিয়ে বলা হয়েছে আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। সরকারী দলের সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ভোটারদের ওপর পুলিশও হামলা করেছে। অনেক জায়গায় ভোটারদের প্রকাশ্যে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করছে সরকারী দলের লোকজন। বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। পীরগঞ্জে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বাইরে থেকে তালা লাগানো, কিন্তু পরে দেখা যায় ভেতরে সরকার দলীয় লোকজন নৌকা মার্কায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরা ও নকল ভোটার দিয়ে বুথ জ্যাম করে রাখা হয়েছিল। এর আগে সিপিবি’র এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘ভুয়া ভোটের ভুয়া নির্বাচন’ বলে অভিহিত করে বলেছে, এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত রায় জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে দলটির নেতারা বলেন, ‘ভুয়া বিজয়’ নিশ্চিত করার জন্য নানা ধরনের প্রহসন ও কারচুপির বলয় আগেই তৈরি করেছিল শাসক দল। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যূনতম ভিত্তিকে এভাবে বলি দেয়ার ব্যবস্থা তারা আগেই করে রেখেছিল। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণভাবে একটি ‘ভুয়া নির্বাচন’। যাদেরকে এভাবে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করার আয়োজন করা হয়েছে তারা নিজেদেরকে কোন মতেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বলে দাবি করতে পারবে না। জনগণ তাদেরকে ‘ভুয়া প্রতিনিধি’ বলেই বিবেচনা করবে। ভুয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদও ‘জনপ্রতিনিধিদের সংসদে’র মর্যাদা দাবি করতে পারবে না। সেটিকে জনগণ ‘ভুয়া সংসদ’ হিসেবেই গণ্য করবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যূনতম ভিত্তিকে এর দ্বারা বলি দেয়া হবে। এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং তার দলের দুই প্রার্থী নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন। জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২ আসন থেকে কোদাল মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তার দলের দুই প্রার্থী জুলহাসনাইন বাবু পাবনা-১ আসনে এবং হাসান মারুফ রুমী চট্টগ্রাম-১০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সন্ধ্যায় গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান জোনায়েদ সাকি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন কতটা সরকারী দাসবৃত্তি করেছে, সেটা আপনারা আজ দিনব্যাপী দেখেছেন। এই রকম আতঙ্কের পরিবেশে এর আগে কোন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।’ জোনায়েদ সাকি অভিযোগ করেন, ‘ঢাকা-১২ আসনে প্রায় সব কেন্দ্রে সকাল থেকেই পোলিং এজেন্টদের নানাবিধ হয়রানি করা হয়েছে। এজেন্টদের কার্ড না দেয়া, কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেয়া, এজেন্টদের মারধরের মুখেও পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা-এসব ছিল সাধারণ ঘটনা। প্রতিবাদ করায় মারধর করে এজেন্টকে ধরে নিয়ে স্থানীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। জোনায়েদ সাকি আরও অভিযোগ করেন, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে এই পাতানো নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করা হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ কার্যত রুদ্ধ করে ভয়ের আবহকে বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দাবি করছি, এই নির্বাচন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এদিকে ব্যাপক কারচুপি ও ভয়ভীতি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে বাম ঐক্যফ্রন্ট। বাম ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ক ও গণমুক্তি ইউনিয়নের আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন নাসু এক বিবৃতিতে এই প্রহসনের ও ভয়ভীতির নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। ফলাফল প্রত্যাখ্যান বাম জোটের ॥ রবিবার সন্ধ্যায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রেস ব্রিফিং-এ নেতৃবৃন্দ নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলেন, গোটা দেশকে অবরুদ্ধ করে কোটি কোটি ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করে আরও একবার যে জবরদস্তিমূলক প্রহসনের নির্বাচন মঞ্চস্থ করা হলো বাম গণতান্ত্রিক জোট এই নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। প্রেস ব্রিফিং-এ লিখিত বক্তব্য রাখেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশ চক্রবর্তী, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের হামিদুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা মনির উদ্দিন পাপ্পুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। প্রেস ব্রিফিং-এ নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভর্তি করে রাখা নিরাপত্তার নামে নজিরবিহীন ভয়ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ন্যক্কারজনক ভূমিকা, বাম জোটের একাধিক প্রার্থীসহ বিরোধীদলগুলোর প্রার্থী ও এজেন্টদের আটক, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেয়ায় দেশবাসীও তাই মনে করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে গোটা নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে ও আশঙ্কানুযায়ী নির্বাচনে সরকারের ছকেরই বাস্তবায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ভোর থেকেই দেশব্যাপী ভোট কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্য জালিয়াতি, ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে নৌকা মার্কার সিল মারতে বাধ্য করা, বিরোধী দলীয় ভোটারদের জোর করে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, কোথাও সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে সমগ্র নির্বাচনকে পুরোপুরি অর্থহীন ও হাস্যকর করে তোলা হয়েছে। ব্রিফিং-এ বলা হয়, এই সমুদয় তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ভোটারদের মধ্যে ভোট নিয়ে যেটুকু আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রেস ব্রিফিং-এ উল্লেখ করা হয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে কোন অবকাশ নেই তা আরেকবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে না। এই নির্বাচনে জনগণের মতামতের কোন প্রতিফলন ঘটেনি।
×