ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

শিকড়ে ফেরার আহ্বান জয়নুল মেলায়

লোকায়ত জীবনের নির্মোহ রূপ, সরল শিল্পভাষা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

লোকায়ত জীবনের  নির্মোহ রূপ,  সরল শিল্পভাষা

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলার লোকশিল্পের প্রতি কী যে টান ছিল জয়নুল আবেদিনের! তার আঁকা ছবিতে সেই অনুরাগ বারবার প্রকাশিত হয়েছে। শিল্পাচার্য শেকড় আঁকড়ে ধরেছিলেন। নিজের চর্চায় চিন্তায় ধ্যানে জ্ঞানে ছিল তৃণমূলের সংস্কৃতি। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে তিনি ফোক ফর্ম সংগ্রহ করেছেন। বাঙালীর মৌলিক চর্চাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জোর চেষ্টা ছিল তার। অভিন্ন চাওয়া থেকে এখন আয়োজন করা হয় জয়নুল মেলার। এবারও জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ এই মেলার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগ। আয়োজকরা মহান শিক্ষাগুরুকে স্মরণ করেন না শুধু, তার চিন্তাকে আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। নকল দেখে দেখে রুচি যখন নষ্ট হতে চলেছে, যখন ধার করা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত নাগরিক সমাজ তখন প্রকৃত পথটি খুঁজে নেয়ার সুযোগ করে দেয় জয়নুল মেলা। পাঁচ দিনব্যাপী আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় গত মঙ্গলবার। একদিন হাতে রেখে শুক্রবার মূল মেলাটি শেষ হয়েছে। কেমন ছিল এবারের আয়োজন? উত্তরে চট করে বলে দেয়া যায়, ভাল। প্রতিদিনই জমজাট ছিল চারুকলা অনুষদের খোলা চত্বর। রাজধানী শহরে চিরায়ত বাংলার রূপ। গ্রামীণ মেলার চেহারা। দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লোকশিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ঢাকায় এনেছিলেন আয়োজকরা। মোট ১৭টি স্টল। এক একটি স্টল ঐতিহ্যবাহী এক একটি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। আলাদা আলাদা স্টলে ছিল মৃৎশিল্প, কাঁসা-পিতল শিল্প, শঙ্খ শিল্প, নক্সিকাঁথা সুচিশিল্প, শীতলপাটি, শোলা শিল্পসহ অন্যান্য বিলুপ্ত প্রায় শিল্পের নিদর্শন। বংশ পরম্পরায় কাজ করে যারা নিজের শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারাই মেলায় এসেছিলেন। এ দলে প্রবীণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের নামেই স্টলগুলোর নামকরণ করা হয়। পাশাপাশি অনেকগুলো স্টলে দেখা যায় তরুণ প্রতিনিধিদের। পিতার পরিবর্তে সন্তানরা এখন কাজ করছেন। দেখে আশাবাদী হতে হয়। একটি স্টলে ছিল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি। রঙিন হাঁড়ি তৈরি করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন সুশান্ত কুমার পাল। তবে মেলায় দেখা গেল তার উত্তরাধীকার সঞ্জয় কুমার পালকে। স্টলে বসেই শখের হাঁড়ি অলঙ্করণ করছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দুই ভাই বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছি। অনেকদিন ধরে শখের হাঁড়ি তৈরি করছি। এখন কাজটা খুব ভাল লাগে। এর বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারি না। তার মানে ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে পরের প্রজন্ম। রাজশাহীর অন্য একটি স্টলে ছিল টেপা পুতুল। শিল্পী সুবোধ কুমার পাল। নরম মাটি টিপে অসংখ্য ছোট ছোট ফিগার গড়েছিলেন তিনি। খুব যে নিখুঁত অবয়ব তা নয়। তবে রূপটা এত আদি ও অকৃত্রিম যে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গ্রামীণ মেলায় সেই কবে কোন্ কালে দেখা পুতুলের স্মৃতি চোখের সামনে যেন জলজল করে ওঠে। একটি স্টলে ছিল কাঠের পুতুল। চাকা লাগানো ঘোড়া। দেখেই বোঝা যায়, সোনারগাঁ এলাকার ঐতিহ্য। এ ধরনের পুতুল তৈরিতে খুব প্রসিদ্ধ শাহ্পুর। গ্রামের মাত্র দুটি পরিবার এখনও পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রেখেছে। আশুতোষ সূত্রধর বর্তমানে তিনকোণা মেয়ে ও ছেলে পুতুল তৈরি করছেন। মেলার একটি স্টলে তার বানানো পুতুল প্রদর্শিত হয়। কাঠ খোদাই করে ঘোড়া ও হাতির অবয়ব তৈরি করেন শিল্পী। তার পর উজ্জ্বল রঙে আঁকা হয়েছে চোখ মুখ। পুতুলগুলো দেখতে খেলনার মতো। মিসরের মমির মতোও মনে হয়। তাই মমি পুতুল নামেও পরিচিত বলে জানান শিল্পী। মেলায় শোলা শিল্পের নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন মাগুরার রামপ্রসাদ মালাকার। শোলা কেটে ফুল পাখি ইত্যাদি বানিয়েছিলেন তিনি। শাঁখা শিল্পের নিদর্শন নিয়ে মেলায় এসেছিলেন পুরান ঢাকার অনুপ নাগ। বাপ-দাদার পেশা তিনি আজও ধরে রেখেছেন। তার স্টলে কারুকাজ করা শাঁখা। সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা শঙ্খ। এগুলোর গা কেটে চমৎকার সব শিল্পকর্ম গড়া হয়েছিল। শিল্পী বলছিলেন, শাঁখারী বাজারের অধিকাংশই এখন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে আমদানি করে। আমি নিজে কারিগর। বাকি জীবন এই কাজ করে কাটাতে চান বলে জানান তিনি। ধাতব শিল্পের চমৎকার একটি স্টল ছিল মেলায়। ধামরাইয়ের প্রবীণ কাঁসা-পিতল শিল্পী রাশেদা মোশারফ বহুকাল ধরে এ কাজ করছেন। প্লেট গ্লাস তো ছিলই। পাশাপাশি তিনি বাকুরার ঘোড়া, মিসরের মূর্তি, হিন্দু মিথলজির নানা চরিত্রকে গড়ে নিয়েছিলেন। এক ধরনের নীরিক্ষা। বেশ লাগে দেখতে। তবে রাশেদার গড়া পণ্য মেলায় নিয়ে এসেছিলেন তার জামাতা। তিনি জানান, শাশুড়ির কাছ থেকে কাজ শিখেছেন তিনিও। মেলা নিয়ে বিপুল আগ্রহ দেখিয়েছেন শহুরেরা। যা-ই পছন্দ হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে কিনে ফেলেছেন। এমনকি একটু দেরি করলে আর সেটি পাওয়া যায়নি! মৌলভীবাজার থেকে শীতলপাটি বুনে নিয়ে এসেছিলেন গীতেশ চন্দ্র দাস। গতবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিক্রি হয় না। না বিক্রি হলে কী করে চলবে আমাদের? এবার ঠিক উল্টো। তিনি জানান, অনেক ভাল বিক্রি হয়েছে। এমনকি ২০ হাজার টাকা দরের শীতল পাটিও মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। নরম বেতের মিহি বুনন। সেইসঙ্গে নানা নক্সা। সহজ কাজ নয়। কী করে পারেন? জানতে চাইলে আরেক শিল্পী হরেন্দ্র কুমার দাস বলেন, সাধনাই সব। বেশি কাজের একটি শীতলপাটি তৈরি করতে একজন শিল্পীর এক মাস সময় লেগে যায় বলে জানান তিনি। ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি এখন তারা সমকালীন চাহিদার কথাও মাথায় রাখছেন। এ কারণে টেবিলম্যাট ওয়ালম্যাট ইত্যাদিও তৈরি করছেন। বিকল্প ব্যবহারের লক্ষ্যে শৌখিন ক্রেতারা এসব পাটি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় পাটি বুনার বেতের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এখন তারা নিজেরাই বেত গাছের চাষ করছেন বলে জানান হরেন্দ্র। তার মানে, গল্পটা আশাবাদী হওয়ার। মেলায় নক্সিকাঁথাও বিক্রি হয়েছে খুব। সুচি শিল্পের এই নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুনা বেগম। মাঝ বয়সী সুচি শিল্পী তার হাতের কাজ দেখিয়ে রীতিমতো চমকে দেন দর্শনার্থীদের। সুইয়ের প্রতিটি ফোঁড় যেন কথা বলে। গল্প বুনে চলে। প্রাচীন সেলাইয়ে নতুন ফর্ম। আধুনিক নক্সা। দামও অনেক। কিন্তু তারও বেশি কাজ। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। স্টলের সামনে ভিড় লেগেছিল সব সময়। রুনা জানান, প্রতিটি কাঁথা লম্বা হাতে বুনা। লম্বা সময় ধরে একটু একটু করে বুনতে হয়েছে। নিজের ভাললাগা থেকে নক্সিকাঁথার কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি সুই সুতো নিয়েই থাকব। শীতের কাল হলেও মেলার একটি স্টল হাতপাখা দিয়ে সাজানো ছিল। সেখানে সোনারগাঁয়ের সন্ধ্যা রানী আপন মনে পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন। আজকের দিনে হাতপাখা কে আর ব্যবহার করবে? কিন্তু রঙিন হাতপাখা হাতে নিয়ে ঠিকই দেখেছেন লোকশিল্পপ্রেমীরা। এই স্টলের মূল শিল্পী ছিলেন সুচিত্রা রানী। প্রবীণ নারী কিশোরী বয়স থেকেই হাত পাখা তৈরি করতেন। হাতপাখা নিয়ে প্রতি বছর এই মেলায় ওই মেলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। এবার আর নেই। কেন? জানতে চাইলে স্টলে বসে থাকা পুত্রবধূ সন্ধ্যা রানী বলছিলেন, গত কয়েক দিন আগে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি! হারিয়ে যাওয়ার আগেই বাঁচাতে হবে লোকশিল্পকে- এই আকুতিই যেন জানিয়ে গেলেন তিনি। মেলায় স্টল সাজিয়েছিলেন চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরাও। সদ্য আঁকা চিত্রকর্ম, মাটির পুতুল, কাঠের শিল্পকর্মসহ নানা আকর্ষণীয় উপস্থাপনা ছিল তাদের। বিশেষ করে ভাস্কর্য বিভাগের প্রদর্শনী ছিল দেখার মতো। চমৎকার সব ভাস্কর্য দিয়ে একটি কর্ণার সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। নতুন বছরের ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ইত্যাদিতেও দারুণ সব কাজ করেছিলেন আগামীর শিল্পীরা। দেখা মাত্রই কিনে ফেলেছেন ক্রেতা। উৎসবের আরেকটি আকর্ষণ জয়নুল আবেদিনের সংগৃহীত টেপা পুতুলের বিশেষ প্রদর্শনী। জয়নুল গ্যালারিতে চলছে এ প্রদর্শনী। সব মিলিয়ে বেশ সমৃদ্ধ আয়োজন। আগেই বলা হয়েছে, প্রায় সব স্টলে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতির নিদর্শন। দেখে মন কেমন যেন আবেগী হয়ে ওঠে। শৈশবে ফিরে যায়। হারানোর একটা ব্যাথা বাজে বুকে। এভাবেই কি হারিয়ে যাবে সব? না, হারিয়ে যাওয়ার আগে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ। এ তাগিদ থেকেই জয়নুল মেলা। শিল্পাচার্য বলেছিলেন, ‘এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয় না।’ উক্তি তো নয়, ক্ষোভ। সেই কবে এই হতাশার কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পাচার্য! এখনও অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই নষ্ট হচ্ছে রুচি। অন্যের চর্চায় আরও বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠছে বাঙালী। শেকড় থেকে বিচ্যুত। এ অবস্থায় সুচিন্তা ও সুরুচির প্রকৃত ধারণা দেয় জয়নুল মেলা। মেলা প্রসঙ্গে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, আয়োজনটির মধ্য দিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে স্মরণ করি আমরা। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সেইসঙ্গে লোকায়ত জীবনের কাছে শিল্পের কাছে গিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করতে চাই। এ কারণেই মেলার আয়োজন বলে জানান তিনি।
×