ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

নৌকায় ভোট দিন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

নৌকায় ভোট দিন

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আমি পুরান ঢাকার একটি নির্বাচন কেন্দ্রে হাজির ছিলাম। এই নির্বাচন কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুসলিম লীগের (কাউন্সিল) খাজা খয়েরুদ্দীন। আমার এখনও স্মরণ আছে, পুরান ঢাকার শরৎ গুপ্ত রোড ধরে একটি সেকেলে পালকি যাচ্ছে ভোট কেন্দ্রের দিকে। আমি ঢাকার রাস্তায় কখনও পালকি দেখিনি। তাই একটু বিস্মিত হলাম। ঢাকা তখন রিক্সার শহর। পালকির চল উঠে গেছে। ভোট কেন্দ্রে পালকিটি থামতেই দেখি দু’জন যুবক প্রায় কোলে করে এক বৃদ্ধকে পালকি থেকে নামাচ্ছেন। তার বয়স নব্বইয়ের কম হবে না। চলাচলের শক্তি নেই। কৌতূহল হলো। তার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, এই বয়সে এই শরীর নিয়ে ভোট দিতে এসেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ বাবা এসেছি। আগে শরীর ভাল ছিল। কিন্তু ভোট দেয়ার গরজ কম ছিল। এবার নৌকায় ভোট দিতে এসেছি। শেখ মুজিবুরকে ভোট দিতে এসেছি। আমার এই একটা ভোটও এবার খুব মূল্যবান। এবার নৌকা হারলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে বাবা। আমরা পাঞ্জাবীদের গোলাম হয়ে যাব। আটচল্লিশ বছর আগের কথা। কিন্তু ঘটনাটি এখনও আমার মনে আছে। এত বছর পর আরও বেশি করে মনে পড়ল আর দু’দিন পরের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে নিয়ে। এবারের নির্বাচনেও বাংলার মানুষের স্বাধীনতা, সম্মান ও অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রতীক নৌকা। নদী-বিধৌত বাংলার মানুষের বাঁচা-মরার লড়াইয়ের প্রতীক নৌকা। এই প্রতীক ছিল ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানীর। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। এবারেও এটা সাধারণ একটি নির্বাচন নয়। বাংলাদেশ ও বাঙালীর অস্তিত্ব এবং স্বাধিকার রক্ষার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে নৌকা এবারও লড়াকু। ১৯৭০ সালে নবেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও প্লাবনের পর যখন ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন ঝড়ে ভয়ানকভাবে বিধ্বস্ত ভোলার এক বৃদ্ধকে বলতে শুনেছি, ‘সেই অতীতে মহাপ্লাবনে যখন দুনিয়া ধ্বংস হতে চলেছে, তখন নূহ নবী নৌকা তৈরি করে দুনিয়ার সকল জাতি, প্রজাতির জীবজন্তু নৌকায় তুলে নিয়ে বিশ্বের প্রাণীজগৎ রক্ষা করেছিলেন। এবার বাংলাদেশে ঝড় ও মহাপ্লাবনের পরপরই বাংলার মানুষকে রক্ষার জন্য শেখ মুজিবুর এসেছেন নৌকা নিয়ে। এই নৌকাকে নির্বাচনে জয়ী না করলে দেশ যেমন বাঁচবে না, তেমনি পাকিস্তানীদের শোষণ-শাসন থেকে আমরা মুক্ত হব না। ইতিহাসের কী পুনরাবৃত্তি! ১৯৭০ সালের মতো ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচন সামনে নিয়ে দেশ আজ একটি মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন, যে আদর্শের জন্য ত্রিশ লাখ নরনারী আত্মাহূতি দিয়েছে, মানুষ যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছে, এই নির্বাচনের পর তা টিকে থাকবে কিনা! নৌকা নির্বাচনে জয়ী না হলে আশঙ্কা রয়েছে পঁচাত্তর পরবর্তী ‘এজ অব ডার্কনেস’ আবার বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারে। একমাত্র নৌকার বিজয়ই পারে তাকে ঠেকাতে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের রণাঙ্গনের মানচিত্রও এখনও বদলায়নি। এই নির্বাচনী যুদ্ধের একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের শিবির, অন্যদিকে একাত্তরের ঘাতক, দালাল, স্বাধীনতা যুদ্ধের শত্রুপক্ষ ও তাদের নয়া দোসরদের শিবির। এই নির্বাচনী যুদ্ধে তারা জয়ী হলে শুধু দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ধারাই রুদ্ধ হবে না, বাঙালী ও বাঙালিত্ব এবং তার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিমূলেও আঘাত পড়বে। নব্যধনীদের অগাধ লুটের বাজার হবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের নতুন ঘাঁটি হবে বাংলাদেশ। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো হবে একটি ‘কিলিং ফিল্ড’। জাতির বাঁচা-মরার এই যুদ্ধে যারা নিরপেক্ষ থাকতে চান, তাদের উদ্দেশে বলি, ‘থাকতে কি চাও নির্বিরোধ রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।’ এই রাজনৈতিক সচেতনতার যুগে বাংলার মানুষ ভুল করবে তা আমি বিশ্বাস করি না। অতীতে ভুল করার অনেক খেসারত আমরা দিয়েছি। সেই ভুল আমরা যেন আর না করি। কিছু দলত্যাগী নীলবর্ণ শৃগালের কথায় আমরা যেন না ভুলি। আমিও বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ। দেশের সকল মানুষের কাছে আমার আকুল আবেদন, নৌকা প্রতীকে ভোট দিন। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের আবার পরাজিত করুন। নৌকায় ভোট দিন। লন্ডন, ২৭ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২০১৮।
×