ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৭ যুদ্ধাপরাধী এবার ভোটে লড়বে ধানের শীষে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

৭ যুদ্ধাপরাধী এবার ভোটে লড়বে ধানের শীষে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কেবল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া আর যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সন্তানদের মনোনয়ন দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বিএনপি। এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত শীর্ষ চল্লিশ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে আট যুদ্ধাপরাধীই বিএনপির প্রার্থী হয়ে ‘ধানের শীষ’ নিয়ে নির্বাচনে আসছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত, অভিযোগ দাখিলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য বলছে সরাসরি যুদ্ধাপরাধে জড়িত ৮ বিএনপির প্রার্থী। ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচনে আছে বিএনপি-জামায়াতের ২৫ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর সন্তান। ধানের শীষ নিয়ে লড়ছেন আরও ২৫ জামায়াত নেতা। গত ২৯ নবেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন যুদ্ধাপরাধীকে বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক দেবে না। তিনি আবার বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটিরও প্রধান। তিনি বলেন, কোন যুদ্ধাপরাধীকে আমরা ‘ধানের শীষ’ প্রতীক দেব না- এটা আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি। এ বিএনপি নেতার দাবি, ‘জামায়াতের মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আছে।’ নজরুল ইসলাম খানের ঐ বক্তব্যের পর থেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনা। জামায়াতে মুক্তিযোদ্ধা আবিষ্কারে বিএনপি নেতার বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে মনোনয়ন দেয়ার পর দেখা গেল জামায়াত আর যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি বিএনপির আগ্রহ আছে আরও কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াত নিজের প্রতীকের বাইরে গিয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নির্বাচনে লড়ছে। ইতোমধ্যেই ২৫ জামায়াত নেতা পেয়েছেন বিএনপির সমর্থন ও প্রতীক। যারা রীতিমতো ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরও প্রার্থী হয়ে হাজির হচ্ছেন জনগণের কাছে। বিএনপি আসন ছেড়ে দেয়ায় অন্তত ওই আসনগুলোতে ড. কামাল হোসেনের ফ্রন্ট নেতাদের কাছে প্রার্থী হচ্ছেন জামায়াত নেতারা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই জানা গেল নতুন তথ্য। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া আর যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সন্তানদের মনোনয়ন দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বিএনপি। আইসিটি তদন্ত, অভিযোগ দাখিলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য বলছে সরাসরি যুদ্ধাপরাধে জড়িত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী ৮। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও ইতোমধ্যেই এসব প্রার্থীর বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। বিএনপির প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ নিয়ে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে নির্বাচন করছেন মাওলানা আবদুল হাকিম, গাজী নজরুল ইসলাম আছেন সাতক্ষীরা-৪ আসনে, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী আছেন সিলেট-৫ আসনে, মাওলানা হাবিবুর রহমান নির্বাচন করছেন সিলেট-৬, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনা-৫, গিয়াস কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম-৭ এবং আ ন ম শামসুল ইসলাম আছেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনে, বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি) আসনে আব্দুল মোমিম তালুকদার খোকা। এর মধ্যে সিলেটে মাওলানা হাবিবুর রহমানকে মনোনয়ন দেয়া নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রতিবাদমুখর হয়েছে দলের তরুণ নেতাকর্মীরা। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি যদি আপনার শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তাহলে এই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীদের বয়কট করুন। নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত সাকা চৌধুরীর পরিবারেই আস্থা রেখেছে বিএনপি। রাউজান আসনে সালাউদ্দিন কাদেরের ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে বিএনপি। অধিকাংশ আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী দেয়ার ধারাবাহিকতায় রাউজানেও গিকা চৌধুরীর সঙ্গে তার ছেলেকে রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে ‘হত্যার হুমকির’ মামলায় এখন কারাগারে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিকা চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদের মানহানিসহ আরও তিন মামলা রয়েছে। সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি) আসনে আবার বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন যুদ্ধাপরাধ মামলার পলাতক আসামি আব্দুল মোমিম তালুকদার খোকা। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন খোকার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন তার মেয়ে নাছিমা আক্তার লাকি। এই আসনে খোকার বিকল্প হিসেবে তার স্ত্রী মাসুদা মোমিনও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দুইবারের সংসদ সদস্য খোকা যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বিদেশে পলাতক। বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মোমিন তালুকদার খোকার বিরুদ্ধে একাত্তরে আদমদীঘিতে হত্যা, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আদমদীঘির কায়েতপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ সুবেদ আলী ২০১১ সালের মার্চে বগুড়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এই বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা করলে পরে তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। মামলার নথি থেকে জানা যায়, একাত্তর সালের ২৪ নবেম্বর আদমদীঘি বাজারে পশ্চিমে খারির ব্রিজের উত্তর শ্মশান ঘাটে মোমিন তালুকদার গুলি করে মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল হক তালুকদার টুলু, আব্দুস ছাত্তার, আব্দুল জলিল, আলতাফ হোসেনসহ আরও কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। মোমিনের বাবা আব্দুল মজিদ তালুকদার (বর্তমানে মৃত) মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল এবং বাবা-ছেলে দুজনেই সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। অন্যদিকে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হতে চাইছেন নুরুল ইসলাম আনছার প্রামাণিক। কুষ্টিয়া-৪ আসনে বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয় ২০০৯ সালের ১০ জুন। খোকসা থানায় করা ওই মামলা ’১৫ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থান্তান্তর হয়। এই মামলায় আনছার চার নম্বর আসামি। ২০০৯ ও ’১০ সালে কুষ্টিয়া শহর ও কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে যে রাজাকারের তালিকা হয়, সেখানে নাম আছে আনছারের। ওই তালিকায় জিয়ার আমলে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, এরশাদ সরকারের সাবেক খাদ্য প্রতিমন্ত্রী কোরবান আলীর পরই আনছারের নাম আছে। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় আনছার প্রামাণিক কুমারখালীতে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। রাজাকাররা কুমারখালী বাজারে কালীদাস, কালাদত্ত ও চিত্তশার দোকান লুট করে। এ ছাড়া যদুবয়রা গোবিন্দপুর গ্রামে গৌড় ঠাকুরের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। কুমারখালীর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএনপির এই প্রার্থী অনেক বাড়িতে লুটপাট করেছে। বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর তার পরিবার বেশি নির্যাতন করত। কুমারখালী-খোকসার মাঝামাঝি কয়েকটি গ্রামে সে লুটপাট চালিয়েছিল। কুমারখালী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি এটিএন আবুল মনছুর মজনু জানান, একাত্তরে হেলালপুর গ্রামের বীরেন্দ্র নাথ ও ধীরেন্দ্র নাথ নামে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের ছোট ভাই হরেন্দ্র নাথ আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করে। সেটা এখনও তদন্তাধীন। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের বেশ ক’জন সদস্য সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে তারা ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়তে চান। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী, নিজামী, সৈয়দ কায়সার, আব্দুল আলীম, সাকা চৌধুরীর পরিবারের একাধিক সদস্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে আব্দুল আলীম, কায়সার ও সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা সরাসরি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও নিজামী-সাঈদীর পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে নিজামী-সাঈদীপুত্ররা বিএনপি মহাসচিবের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। পিরোজপুর-১ আসনে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর পুত্র জামায়াত নেতা শামীম সাঈদী বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। পাবনা-১ (সাঁথিয়া-বেড়া) আসনে ফাঁসিতে দ-িত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নিজামী পুত্র জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনিও নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়তে চান। যদিও এই আসনে অন্য একজনের নাম সামনে চলে আসায় দলের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। জয়পুরহাট-১ (সদর ও পাঁচবিবি) আসনে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীমের পুত্র ফয়সল আলীম মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ফয়সল আলীম বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ও জেলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য। জিয়ার সময়ের বিএনপি নেতা এবং এরশাদ সরকারের কৃষি প্রতিমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ কায়সারের ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সল হবিগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিল। এসব বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা ইতোমধ্যেই বলেছেন, নির্বাচনের চার মাস আগেই সভা-সেমিনার করে সব রাজনৈতিক দলকে আহ্বান করেছি তারা যেন এ ধরনের লোককে মনোনয়ন না দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মনোনয়ন দাখিলে পরে দেখলাম জামায়াতের ২৫ এবং তার বাইরেও অনেক চিহ্নিত রাজাকারকে নমিনেশন দিয়েছে বিএনপি। রাজাকার যারা মনোনয়ন পেয়েছে আমরা তাদের প্রতিহত করব। যেসব আসনে এ রকম কাউকে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে, সেসব আসনে আমরা পোস্টারিং করে জনগণকে ভোট দিতে নিষেধ করব। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, দেশের মানুষ রাজাকার মুক্ত একটি সংসদ চায়। কিন্তু বিএনপির ২৫ জনের মতো প্রার্থী করেছে, যারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। এতেই প্রমাণিত হয়, বিএনপি জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের দ্বারা ফের পাকি ভাবনায় একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাতে ষড়যন্ত্র করছে। শাজাহান খান বলেন, নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন যে, তারা কোন যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যকে ধানের শীষে প্রার্থী করবে না। কিন্তু সাইদীর ছেলে শামীম সাঈদী, জয়পুরহাটের আলীমের ছেলে, চট্টগ্রামে সাকা চৌধুরীর ভাইসহ অনেকেই আছে, যারা যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্য। সুতরাং বিএনপি সব সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা কথা বলে যায়।
×