ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীল অর্থনীতি বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

 নীল অর্থনীতি বঙ্গোপসাগর  এবং বাংলাদেশ

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সমুদ্র অর্থনীতি এবং একে সম্ভাবনাময় নীল অর্থনৈতিক কাঠামোতে রূপান্তর করা। দ্বীপ রাষ্ট্র এবং সমুদ্রবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশে সমুদ্র অর্থনীতির পরিবেশ সম্মত ব্যবস্থাপনাই নীল অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। মূলত সমুদ্র তলের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার বাড়িয়ে অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে পরিবেশ সংরক্ষণ এই অবকাঠামোর মূল পরিধি। ইতোমধ্যেই সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে, অনেক দেশ কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সমুদ্র কেন্দ্রিক বাণিজ্য, সমুদ্রের সম্পদ আহরণ কৌশল এবং সমুদ্রযানের ব্যবহার অনেক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করেছে। ডাচ্, ডেনিস এবং নরডিক অঞ্চলে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে এক বিশেষ ধরনের উন্নয়ন পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ভৌগোলিক সীমারেখায় সমুদ্র থাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রিত করে এর প্রমত্তা রূপকে পরিবর্তন করে আশীর্বাদে পরিণত করেছে এই সকল অঞ্চল। ক্যারিবিয়ান এবং স্কেনডিনেভিয়ান অঞ্চলে সাগর তীরবর্তী পর্যটন শিল্প, নিরাপদ সমুদ্রযানের ব্যবহার, উপকূলীয় প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ আহরণ, সমুদ্র তলের খনিজ সম্পদের উত্তোলন এবং উপকূলে বাণিজ্যিক মাৎস্যচাষ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ প্রচলিত সমুদ্র অর্থনীতির মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। সেই সঙ্গে সমুদ্র উপরিতলের ইকো-সিসটেম সার্ভিস যেমন- বাতাস, সুর্যরশ্মী, ¯্রােত এবং ঢেউকে কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। এশিয়ার মধ্যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র অর্থনীতির অবদান তাদের দেশজ উৎপাদনের অন্যতম উৎস। কিন্তু সাগরে মনুষ্য সৃষ্ট কর্মকা- ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, সমুদ্র দূষণ, অযৌক্তিক পর্যায়ে সামুুদ্রিক সম্পদের আহরণ, সামুুদ্রিক এসিডিফিকেসান এবং অপ্রত্যাশিত প্রজাতির আবির্ভাব সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত। তাই ২০১২ সালে রিও+২০ সম্মেলনে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির এক নতুন কাঠামো প্রবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে যা নীল অর্থনৈতিক কাঠামো হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই কাঠামোর আওতায় সমুদ্রের বাস্তুভিত্তিক পরিশুদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বজায় রেখে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে সাগরতলের বাস্তু-ব্যবস্থা, জীব বৈচিত্র্য এবং নবায়নযোগ্য সম্পদের পুনঃসৃষ্টি নিশ্চিত করে সমুদ্র সম্পদ আহরণ ব্যবস্থাপনায় কাঠামো গড়ে তোলর সুপারিশ করা হয়েছে। এ যেন সমুদ্র অবদানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সমুদ্রের সম্পদ ব্যবহার করা। বিশেষজ্ঞদের মতে এই অবকাঠামোর আওতায় দ্বীপ ও সমুদ্রবেষ্টিত রাষ্ট্র পরিচালিত হলে বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অবদান আসবে সমুদ্র থেকে। কারণ বিকল্প জ্বালানি, নিরাপদ খাদ্য, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং কর্ম সংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস হবে নীল অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে যদি নীল অর্খনীতির কাঠামো সঠিক সময়ে এবং যৌক্তিক পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়। প্রতিবেশী দেশ চীন ৪.৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় সংশ্লিষ্ট অর্থনীতির অবদান ৯৬২ বিলিয়ন ইউএস ডলার যা ৯ মিলিয়ন লোকের কর্ম সংস্থানের উৎস। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ২১ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বর্ধিত অর্থনৈতিক অঞ্চল নীল অর্থনৈতিক কাঠামোর আওতায় আসলে কমপক্ষে ২৫.৩২ বিলিয়ন ইউএস ডলার সমমূল্যের অবদান জিডিপিতে আসা সম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৯টি জেলার ১৪৮টি উপজেলা জুড়ে ৫৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রতট রেখা যে জীব বৈচিত্র্যের আধার তা আন্তর্জাতিক মানের বুনো শৈবাল আহরণ ও উৎপাদন সম্ভব। নতুন করে নীল অর্থনীতির কাঠামোয় এই খাতে ২ লাখ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। মূলত রূপান্তর প্রক্রিয়ায় স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগ করে কর্ম কৌশল গ্রহণ করলে আগামী এক যুগের মধ্যে কাক্সিক্ষত অবদান পাওয়া সম্ভব। স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনায় উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র শৈবাল, মৎস্য চাষ, কাকড়া এবং মলাস্ক জাতীয় মাৎস্যের বাস্তু-ব্যবস্থাপনা ভিত্তিক উৎপাদন প্রযুক্তির প্রবর্তন ও সম্প্রসারণ করলে দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবিকায়নের জন্য নতুন পš’ার উদ্ভব হবে। ভূমিহীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে ইকোলজি বিষয়ে স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১৯৪০০ বর্গ কিলোমিটার অগভীর সমুদ্র অঞ্চলে সি-উইড চাষ ও আহরণ ব্যবস্থাপনায় বিনিময়যোগ্য কাস্টমারী রাইটের লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। এতে করে প্রন্তিক জনগোষ্ঠীর বণ্টনভিত্তিক ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে। অপ্রচলিত অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিফুডের ভেল্যু চেইন উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ সি-উইড প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষুদ্র শিল্পায়ন স্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে সমুদ্রে বিরাজমান সম্পদের সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করে তার ইনভেন্টরি প্রণয়ন করতে হবে। মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা ও কৌশলের মধ্যে মেরিটাইম ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি যেমন শ্রমিক, ব্যবস্থাপনা স্টাফ, প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে। প্রচলিত সমুদ্র বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল স্তরের দক্ষ জনশক্তির গড়ার জন্য কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস ও কারিক্যুলামে ইকো-লজিক্যাল ধারণা সন্নিবেশিত করতে হবে। যাতে উপকূলীয় অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশ, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙ্গা শিল্প দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয় এবং সমুদ্র উপকূলে মাৎস্য আহরণে টেকশই প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হয়। ৫৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র তট বরাবর কৃত্রিম অবকাঠামোয় বনায়ন সৃষ্টি করে ভূমি উন্নয়ন ও উপকূল রক্ষা করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্ম কৌশলের মধ্যে সমুদ্রভিত্তিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দরকে পূর্ণাঙ্গ দক্ষতায় পরিচালিত করতে হবে। উল্লিখিত নীল অর্থনীতির কাঠামো উন্নয়ন কৌশলে অনবায়ন যোগ্য শক্তির আহরণের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদনে জোর দিতে হবে। সমুদ্র উপরিতলের সুবিশাল সৌরশক্তি ও বাতাসের মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস আহরণের অন্যতম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি ও উন্নত নৌযান ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গভীর সমুদ্রে খনিজ আহরণ মেরিন বায়োটেনোলজি এই নতুন সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মোচন করবে। এই রূপান্তর দীর্ঘ মেয়াদে নতুন কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি, সৃজনশীল উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি সহায়ক হবে। প্রচলিত কাঠামোর বিপরীতে মনুষ্য সৃষ্টি কর্মকা- যেমন- অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে প্রশমিত করে প্রতিটি কর্মপন্থায় জাতীয় উন্নয়নে নীলের ছটায় সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহার প্রকৃতির সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে। যেখানে সরকারী নীতি কৌশল এবং সুশাসনের মাধ্যমে সমুদ্রের প্রাকৃতিক গুণাগুণ ঠিক রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গোপসাগরে নতুন কাঠামোয় রূপান্তর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, খাদ্য ও শক্তির উৎস হিসেবে সমুদ্রের অবদানকে বহুমাত্রিক পর্যায়ে নিয়ে যাবে। মূলত বাংলাদেশ নতুন প্রযুক্তি ও নীল কাঠামোয় সমুদ্র সম্পদের সম্ভাব্যতার সমম্বয়ে জিডিপিতে দীর্ঘ মেয়াদী টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখবে। জনশক্তির গতিপ্রকৃতি সমুদ্রে ভৌগোলিক রাজনৈতিক অধিকার, নিরাপদ খাদ্য অনুসন্ধান, উপকূলীয় নগরায়ন সমুদ্রের প্রতি মানুষের নির্ভরতা এই সম্ভাবনাকে ভবিষ্যতে আরও গতিশীল করবে। তাই এদেশে চলতি শতাব্দীতে নীল কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে অর্খনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।
×