ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

এসএম মুকুল

বিনিয়োগ হোক গ্রামমুখী

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

বিনিয়োগ হোক গ্রামমুখী

গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় এবং বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এটি অর্জন করা যাবে না। তিনি বলেন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণে উন্নয়ন সহযোগীদের আরও একটু উদার হতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গ্রামেও এখন অর্থপ্রবাহ বেড়েছে। গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন, বিদ্যুত, সৌরবিদ্যুত, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি সুবিধা ক্রমেই বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা। বর্তমান সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকাংশই গ্রাম্য এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে উৎপাদন, রপ্তানি আয় এবং বহুমুখী কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এই সুযোগের সুবাদে গ্রামীণ উন্নয়নে প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১০ বছরের ব্যবধানে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গ্রামের জনবলও বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় রূপান্তর ঘটেছে অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে। আগে গ্রাম থেকে অর্থ শহরে চলে যাওয়ার যে রীতি প্রচলিত ছিল, এখন হচ্ছে তার উল্টোটা। এখন বিত্তবানরা শহর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ পাঠাচ্ছে গ্রামে। শহরের মানুষেরা আরও সুখে থাকার জন্য নিজ গ্রামে মাছ চাষ, সবজি চাষ, ফলবাগান, গবাদি পশুর খামার, এমনকি ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পও স্থাপন করছে। গ্রামমুখী এসব কর্মকা-ের ফলে গ্রামেও স্থানীয় অনেক পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেশা বাছাইয়ে বহুমুখিতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৩ সালের শুমারি অনুযায়ী, শহরে ৫১ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এবং গ্রামে ৪৮ দশমিক ৩১ ভাগ প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলত। ১০ বছর পর ২০১৩ সালে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ৫৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০০৩ সালে গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৩৫৮টি। ১০ বছর পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯১ হাজার ৯৭৮-তে। তার মানে, গ্রামীণ অর্থপ্রবাহ ও উন্নয়ন অগ্রসর হচ্ছে। এর পরও সরকারের আরও সুনজর প্রয়োজন। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিটেন্স। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর পাশাপাশি বিনামূল্যে প্রদানকৃত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবাও বড় অবদান রাখছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক যুবক থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। প্রকৃত পক্ষে আমাদের শহরে ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনের প্রধান উপাদানগুলোই আসে গ্রাম থেকে। গ্রামের মাছ, মুরগি, ডিম, হাঁস, কবুতর, গবাদি পশু, শাকসবজি, ধান-চাল থেকে শুরু করে জীবন ধারণের অন্যতম উপাদানগুলোর উৎসই হচ্ছে আমাদের গ্রাম। সেই গ্রামকে অবহেলা করে, গ্রামের উন্নয়নকে উপেক্ষা করে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের আধুনিক শহুরে সভ্যতায় পালিত পিঠা মেলা, বৈশাখী উৎসব, লোকজ উৎসব এবং মেলাগুলো কিন্তু প্রাচীন ও চিরায়ত গ্রামীণ ঐতিহ্য। দুঃখ হয়, গ্রামীণ সভ্যতা আর ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে এই শহরে বাণিজ্য হলেও এর ছিটেফোঁটাও আমাদের গ্রামবাংলার ঘরে পৌঁছে না। আমরা কথায় কথায় গ্রামকে ভালবাসার কথা বললেও সত্যিকার অর্থে কতখানি ভালবাসি? মুখে মুখে গ্রামীণ বা কৃষকের উন্নয়নের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে কতখানি উন্নয়ন চাই কৃষকের। তার প্রমাণ মেলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণে। বিদ্যুত বিল, গ্যাস বিল, ডিশ বিল, ইন্টারনেট বিল, মোবাইল ফোনের বিল, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, চায়নিজ খাবার, বিলাসদ্রব্য, শিক্ষা আর চিকিৎসা খরচ বাড়লে সবই যেন আমাদের সয়ে যায়। শুধু কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ধান, চাল, সবজি, মাছ, মাংস, ফলমূলের দাম বাড়লে বাজারে, ঘরে আর আমাদের বিলাসী শহুরে মানসিকতায় আগুন জ্বলে! অথচ এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এটা কমানো গেলে কৃষকরা হয়তো ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো না। তাই এখনই সময় গ্রামীণ উন্নয়নকে জোরদার করে কৃষি এবং কৃষকদেরকে সামগ্রিক উন্নয়নের মূল ¯্রােতে নিয়ে আসার বিকল্প নেই। কেননা, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরও প্রাণচঞ্চল করার জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের গ্রাম এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। তাদের বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩ অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ৮০ শতাংশের বেশি অকৃষি খাতের হলেও এর ৭১ শতাংশই এখনও গ্রাম বা পল্লীনির্ভর। ৭৮ লাখ ১৮ হাজার অকৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ইউনিট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭১ দশমিক ৪৮ শতাংশই গ্রামভিত্তিক। তাই গ্রামের মানুষকে উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। তথ্যই বদলে দিতে পারে গ্রামীণ চেহারা, গতি-প্রকৃতি, সূচনা করতে পারে আর্থিক সমৃদ্ধির নবদিগন্ত। চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে তথ্য প্রকাশ- চীনের ৯৯ ভাগ শহরে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। অপরদিকে তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধাসহ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের ফলে কৃষকরা অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ছয় গুণ বেশি লাভ করতে পারছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ সুযোগটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। এরফলে কৃষক ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়েও সমৃদ্ধ ও সচেতন হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটলে তরুণরাও হয়ে উঠবে কর্মোদ্দীপক। ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে মেধা, শ্রম, পুঁজি ও সময় খাটিয়ে যতটুকু লাভবান হবে- তার চেয়ে বহুগুণে দেশের মাটিতে কম টাকা বিনিয়োগ করে গ্রামীণ এলাকা থেকেও বিপুল আয় করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতির মধ্যেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের উপভোগ্য অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার বিকল্প নেই। তাই তিনি কি করে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কিভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকের সন্তানকে কি করে শিক্ষা দেয়া যায় -এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের ১০ লাখ ৮০ হাজার জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নে তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধু পুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। এই কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার কৃষক। বন্যা, খরা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই দমাতে পারেনি বাংলার কৃষকদের। নিঃস্ব, শূন্য অবস্থান থেকেও বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল। কৃষকরা প্রকৃতি ও স্বভাবগতভাবে উদ্ভাবক, সৃজনীক্ষমতার অধিকারী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী। গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাত্ত্বিক সূত্র না জানলেও নিবিষ্ট চিন্তা-চর্চা ও প্রকৃতির গতিবিধির সঙ্গে সখ্যর খেলায় উদ্ভাবন করেন নতুন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক চর্চায় নতুন জাতের ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন কৃষক হরিপদ কাপালি। তিনি পেয়েছেন চ্যানেল আইয়ের স্বীকৃতি- কৃষি পদক। আবার অনেক কৃষক নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্ভাবন করছেন নতুন নতুন জাতের ফসল এবং কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি। যশোর অঞ্চলের আফাজ পাগলার ঔষধি গ্রাম, কার্তিক প্রামাণিক কিংবা আজিজ কোম্পানির বৃক্ষপ্রেম এখন রেনেসাঁস দৃষ্টান্ত। চ্যানেল আইয়ের কৃষি পদক এ ধরনের উদ্যোগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষকদের স্বীকৃতি দিতে হবে। কৃষি গবেষকদের সঙ্গে কৃষকের যোগসূত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
×