ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস কথা কইল, ইতিহাসের বুকে আলো জ্বলল

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 ইতিহাস কথা কইল, ইতিহাসের বুকে আলো জ্বলল

সমুদ্র হক ও মনোয়ার হোসেন, ভাসুবিহার, মহাস্থানগড় থেকে ॥ গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা। অন্ধকার নেমে আসছে। হেমন্তের রাত শুরু। প্রাচীন স্থাপনা ভাসুবিহার সুনসান। নীরবতায় হাজারো দর্শক শ্রোতা। কৌতূহলী দৃষ্টি। এরই মধ্যে চেনা কণ্ঠস্বর। মনে হলো ইতিহাস যেন কথা কইছে। অন্ধকার কেটে চারদিক থেকে জ¦লে উঠল আলো। স্টেরিও সাউন্ডে কণ্ঠের প্রতিধ্বনী- “..... লক্ষ বছর আগে জেগে উঠেছিলাম। এতটা কাল আমার অন্তরের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তোমরা আজ আমার বুকে এসে আলো জ্বালিয়ে দিলে।” দেশ বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব (সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) আসাদুজ্জামান নূরের ভরাট কণ্ঠ নিয়ে মহাস্থান ইতিহাস কথা কইলো। প্রত্ন স্থাপনা তখন আলোকময়। নাটকের কলাকুশলীরা ভাসুবিহারের প্রতিটি কীর্তিতে চুমু খেয়ে বুক ঠেকিয়ে বরণ করে নিল। শুক্রবার রাতে বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে প্রত্ন সমৃদ্ধ ভাসুবিহারে এভাবেই শুরু হলো প্রত্ন নাটক ‘মহাস্থান’। ইংরেজী- ‘দ্য গ্রেট ল্যান্ড’। সেলিম মোজাহারের এই নাটকের নির্দেশক শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। জানালেন, বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম প্রত্ন স্থাপনায় গিয়ে এভাবে প্রত্ন নাটক করছে। ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি ও কীর্তির পটভূমিতে উপস্থাপিত এই নাট্যপ্রয়াস প্রত্ন নাটক। যা এক বিশেষ নাট্য প্রকরণ। এর বৈশিষ্ট্য- স্পেস কথা বলে। বিশে^র দেশে দেশে লাইট ও সাউন্ডের সংমিশ্রিত প্রজেকশনে প্রত্ন ইতিহাস তুলে ধরা হয়। আমরাই প্রথম শুধু শব্দ ও আলো দিয়ে নয়। নাট্যাঙ্গিকের যাবতীয় কথা কসরতের যথার্থ প্রয়োগে কালের বিবর্তন দৃশ্যমান করেছি। মহাস্থানগড়ে আছে ১৬টি কালের ইতিহাস। তারই একাংশ ভাসুবিহারে ছিল বৌদ্ধদের কীর্তি উচ্চতর বিদ্যাপীঠ। কয়েকটি মন্দির। যা প্রত্ন খননে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই স্থাপনাতেই মঞ্চস্থ হলো প্রত্ন নাটক মহাস্থান। নাটকটিকে মহানাটক বলা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রত্ন নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে। এক ঘণ্টার এই নাটকের নাম ছিল সোমপুর কথন। এরপর নরসিংদীর উয়ারি বটেশ^রে একই বছরের ৬ জুন মঞ্চস্থ হয় দ্বিতীয় প্রত্ন নাটক। এ বছর ২৩ নবেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রাচীন পু-্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী পু-্রনগর মহাস্থান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ভাসুবিহারে তৃতীয় প্রত্ন নাটক ‘মহাস্থান’ মঞ্চায়িত হয়। যা সোয়া দুই ঘণ্টার। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এটি সবচেয়ে বড় নাটক। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে ২০১৬ সালে এক বছরের জন্য সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পর শিল্পকলা একাডেমির বড় পরিকল্পনায় মহাস্থান প্রত্ননাটকের কাজ শুরু হয়। কথা ছিল সার্কভুক্ত দেশ ও বিশ্বের অতিথিদের সামনে মহাস্থান নাটক প্রদর্শন করা হবে। যা হবে মহানাটক। এই প্রস্তুতির মাঝপথে সার্কের কালচারাল রাজধানী কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত হয়। তবে নাটক মঞ্চায়নের গবেষণা মহড়া ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলতে থাকে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ শিল্পী ও কলাকুশলী এই নাটকে অংশগ্রহণ করছে। মহাস্থান নাটককে আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের সত্যকে শিল্পীত কল্পনার উপস্থাপনায় নির্মিত হয়েছে। যেখানে রয়েছে কয়েকটি কালের ধারাবাহিক উপস্থাপনা। কালের বিবর্তনের বিষয়, পোশাক, সেদিনের হাতিশালের হাতি, ঘোড়াশালের ঘোড়া প্রাচীন যুগের ইতিহাসের সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুয়ের সঙ্গে ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তুলে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে বাঙালী জাতির আড়াই হাজার বছরের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বহু গৌরবময় বর্ণাঢ্য ইতিহাস মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রত্ননাটকের স্পেস দুই ভাগে মঞ্চায়িত হয়। স্টেজ-১ পারফর্মে আছে ভাসুবিহারের তিনটি স্থাপনা। স্টেজ-২ স্টেজ-১ এরই একটি মিনিয়েচার ও রেপ্লিকা। রাজরাজাদের ঘটনা বিহারের ওপরে। তার আশপাশেই যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা। ঘটনাপ্রবাহের রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার নাট্যরূপ ছিল বিহারের নিচের স্পেসে। মনে হয়েছিল ইতিহাসের ঘটনার সত্য রূপায়ণ। নাটকের আখ্যানে মহামতি গৌতম বুদ্ধ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌলিক উপাদানের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে লোকগাঁথা, লোকশ্রুতি, কল্পনা, কিংবদন্তিসহ বহু সাংস্কৃতিক উপাদান। কয়েকটি কালের যাত্রার বহু চরিত্রের আগমন ঘটেছে। ঘটনাবলী ১২টি আখ্যান। যার উপাখ্যান বিন্যাস ছিল ২৪টি। বড় বৈশিষ্ট্য- যে কোন আখ্যান বা উপ-আখ্যান থেকেই গড়ে উঠতে পারে নৃত্যনাট্য। সেই বিষয়টিও দর্শক বিশেষ করে নাট্যকর্মীদের মনে আসন করে নিয়েছে। নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী বললেন, আড়াই হাজার বছর আগের শিকড় ও কয়েকটি কালের পোশাকের বৈচিত্র্য ও বিবর্তন তুলে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এর মধ্যেই ছিল আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, নানা জাতি ধর্মের সংঘর্ষ মিলন মহামিলন। এত কিছুর ভেতর দিয়ে সম্প্রীতির জায়গাটি তুলে এনে নাটকে আঁকা হয়েছে। যার মূলমন্ত্র ‘সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই’। নাটক দেখে মনে হয়েছে এ যেন কোন ইতিহাস রং তুলি দিয়ে মঞ্চ নামের ক্যানভাসে ছবি এঁকে দিচ্ছে। প্রাচীন শিকারযুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, রামায়নের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিসামা, বৈষ্ণব পদাবলি, বাহ্মসঙ্গীত, লোকগান, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ব্রতচারীর গান, পঞ্চকবির গান, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস কাব্যগীত ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা তুলে আনা হয়েছে। যা প্রজন্মকে ইতিহাস জ্ঞানে ঋদ্ধ করার পাশাপশি বাঙালী জাতি সত্তার ইতিহাস, বাঙালী জাতির নানা কীর্তি অর্জন হৃদয়ে গেঁথে দেবে। সম্প্রীতির সহাবস্থানের আলোকিত অধ্যায়ের মধ্যেই মহাস্থান প্রত্ননাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে কয়েকজন নাট্য গবেষক পান্ডলিপি তৈরি করেছেন। প্রত্নস্থপনায় নাটক মঞ্চায়ন ছিল চ্যালেঞ্জ। মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। পল্লী বিদ্যুত সমিতি পুরো নাট্য এলাকা আলোকিত করে দিয়েছে। বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হানা ইসলাম জানালেন, এমন একটি চ্যালেঞ্জিং প্রত্ন নাটক মঞ্চায়নে জেলা প্রশাসন সকল সহযোগিতা দিয়েছে। এই প্রজন্মের জন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা রায়হানা ইসলাম এই নাটক দেখে মুগ্ধ। যা সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পকলা একাডেমির শৈল্পিক এই উপস্থাপনায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। নাটকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যজন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান, নাট্যজন অধ্যাপক আব্দুস সেলিম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ আলতাফ হোসেন, বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ, পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা। পরপর দুই দিনের এই মহা প্রত্ন নাটক মহাস্থানের প্রথম দিন ছিল শুক্রবার।
×