ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার হরিণ চাই ॥ নির্বাচনে বড় দলের টিকেটের জন্য শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২১ নভেম্বর ২০১৮

সোনার হরিণ চাই ॥ নির্বাচনে বড় দলের টিকেটের জন্য শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ

উত্তম চক্রবর্তী/ শরিফুল ইসলাম/ রাজন ভট্টাচার্য ॥ মনোনয়ন নামক সোনার হরিণটি ধরতে মরিয়া বড় বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। হাতে এতটুকু সময় নেই। শেষ মুহূর্তে সোনার হরিণটি ধরতে কেউবা ছুটছেন গণভবনে, কেউবা গুলশানে, কেউবা পল্টন কিংবা মতিঝিলে। বড় দলের সংসদীয় বোর্ডের নীতিনির্ধারক নেতাদের বাড়িতেও পা ফেলানোর জায়গা নেই। সবাই ছুটছেন মনোনয়নের আশায়। এবার যে মনোনয়ন জুটবে না, এটি অনেকে নিশ্চিতভাবে জানলেও তাদের মন মানছে না। তাঁরাও ছুটছেন নেতাদের দ্বারে দ্বারে, আবেদন জানাচ্ছেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার। নির্বাচনী এলাকায় জনভিত্তি থাকুক বা না থাকুক, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সবার মুখেই একই কথাÑ মনোনয়ন দিন, বিজয় নিশ্চিত। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ব্যাপক তদ্বির-ধরণাতে অতিষ্ঠ বড় দলগুলোর নীতিনির্ধারক নেতারা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্ট, ১৪ দলের শরিক দলগুলো, খুচরো ইসলামিক জোট কিংবা বাম গণতান্ত্রিক জোট সব দলেই একই চিত্র। নানাভাবে, নানা কৌশলে এসব নির্বাচনী জোট কিংবা দলগুলোর নীতিনির্ধারক নেতাদের কাছে ধরণা দিয়ে মনোনয়নের জন্য শেষ মুহূর্তের প্রাণান্তকর চেষ্টা আর দৌড়ঝাঁপ দেখার মতো। হাল ছাড়েননি বাদ পড়া মন্ত্রী-এমপি-নেতারাও। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত। ২৫ নবেম্বর আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের ৩০০ আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। এই সময়ের মধ্যে অন্য দল বা জোটের প্রার্থী তালিকাও চূড়ান্ত না করার বিকল্প নেই। তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে কারো কপাল পুড়বে। কেউবা হাসবেন প্রাণখোলা হাসি। এরপর সোনার হরিণ হিসেবে খ্যাত মনোনয়নের টিকেট পেয়ে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে এলাকায় ছুটে যাবেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র...। তবে মনোনয়ন নিয়ে সারাদেশে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চলছে নানা ধরনের গুজব। কোন কোন প্রার্থীর সমর্থকরা এলাকায় মনোনয়ন পাওয়ার কথা প্রচার করছেন। আবার একই দলের অন্য প্রার্থীর সমর্থকরাও করছেন একই কাজ। হচ্ছে মিছিলও। এ নিয়ে বাড়ছে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিবাদ। দূরত্ব। যদিও বড় কোন দল বা জোট থেকে এখন পর্যন্ত মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়নি। প্রকাশ করা হয়নি প্রার্থীদের খসরা তালিকাও। সব দল মিলিয়ে ৩০০ আসনে ইতোমধ্যে প্রায় ১২ হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। হাল ছাড়েননি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ॥ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত। জোট-মহাজোটের সঙ্গে আসন বণ্টনের বিষয়টি সুরাহা হলেই একযোগে ঘোষণা করবে পূর্ণাঙ্গ তালিকা। ইতোমধ্যে যেসব মনোনয়নপ্রত্যাশী চূড়ান্ত তালিকায় নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের দলের হাইকমান্ড থেকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের সমর্থকদের নির্বাচনী এলাকায় উল্লাস চললেও বাদ পড়া নেতারা হাল ছাড়েননি। তারা শেষ মুহূর্তে চেষ্টা তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন। বাদ পড়া কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী গণভবনে গিয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে গিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে পরিবর্তন আসছে খুব কমই। কোন ঝুঁকিতে না যাওয়ার চিন্তা থেকেই দলের বেশির বর্তমান এমপিকে এবারও মনোনয়ন দিতে যাচ্ছে দলের হাইকমান্ড। প্রতিপক্ষ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির প্রার্থীদের মোকাবেলার কৌশল হিসেবে বর্তমান এমপিদের প্রতিই আস্থা রাখছেন তারা। তবে বার্ধক্যজনিত কারণসহ নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত থাকার কারণে হাতেগোনা কয়েকজন বর্তমান এমপি ও মন্ত্রী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেসব স্থানে কয়েকজন আলোচিত নতুন মুখকে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণা করা না হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন আসনে বেশকিছু প্রার্থীর নাম প্রকাশিত হচ্ছে। এতে করে মনোনয়নবঞ্চিত নেতা-এমপিরা ছুটছেন দলটির সিনিয়র নেতাদের কাছে। দল মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা নির্বাচনী এলাকায় তুঙ্গে, সে কথাটুকু তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন। দলের একাধিক জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী জনপ্রিয় প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে, মনোনয়নবঞ্চিতদের একথাগুলো আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করলেও তারা মানতে নারাজ। ‘নৌকা’ প্রতীক হাতছাড়া হলেও হাল ছাড়তে নারাজ এসব মনোনয়নবঞ্চিতের। সে কারণে তাঁরা মনোনয়নের আশায় ছুটছেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন ছাড়াও বড় বড় নেতাদের বাসায়। শেষ চেষ্টা করছেন যদি হাইকমান্ড পুনর্বিবেচনা করেন এ আশায়। ধরণা দেয়া মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের আগামীতে দলে মূল্যায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তাঁদের মন মানছে না। সবারই একটাই চাওয়াÑ মনোনয়ন নামক সোনার হরিণ। কিন্তু রেকর্ড সংখ্যক ৪ হাজার ২৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে থেকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিতে পারবে ২২০ থেকে ২৩০টি। বাকি আসনগুলো জোটের শরিকদের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সবার মন রক্ষা করা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের জন্য একথায় অসম্ভব হলেও বঞ্চিতদের বুঝিয়ে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে একাট্টা হয়ে নির্বাচনী মাঠে নামানোই কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে। বিষয়টি সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত মনোনয়নের তালিকা যার যার মনগড়া। এসব তালিকার কোন ভিত্তি নেই। এ পর্যন্ত কাউকেই মনোনয়নের নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অফিসিয়ালি ঘোষণা না করছি ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজেকে জোটের মনোনীত প্রার্থী দাবি করতে পারবে না। শেষ চেষ্টায় বিএনপিতে দৌড়ঝাঁপ ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ বেড়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দলের নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ের পাশাপাশি সিনিয়র নেতাদের বাসায় বাসায় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তারা লবিং করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশির্বাদ নেয়ারও চেষ্টা করছেন। শুধু রাজধানীতে অবস্থান করা বিএনপি দলীয় প্রার্থীরাই নন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে হোটেল কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে অবিরাম ছুটে চলেছেন এখান থেকে সেখানে। আর তা করতে গিয়ে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারও কারও পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড়। তাদের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরের রাস্তায়ও সবসময় বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় এবার দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ বেশি বলে জানা গেছে। এবার বিএনপির অধিকাংশ মনোনয়ন প্রত্যাশীই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে বেশি সিরিয়াস। আর এ কারণেই তাদের দৌড়ঝাঁপও এবার আগের চেয়ে বেশি। যে করে হোক মনোনয়ন নিশ্চিত করেই তারা ঘরে ফিরতে চান। আর এ কারণেই পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে দূরে ঠেলে এখন তারা সবাই ঢাকায় অবস্থান করছেন। যেন দলীয় টিকেট নিশ্চিত না করে বাড়ি ফিরে যাবেন না। এবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় পুরনো অনেক নেতাই নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন দলের বিভিন্ন পদে থাকা ও সংসদ সদস্য থাকাকালে যারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, তারা এবার মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিয়ে চিন্তিত। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের শরিক দল ছাড়াও বেশ কিছু আসন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে বিধায় অনেক দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে গভীর রাতে ফিরেন। তারপরও তিনি বের হওয়ার আগে এবং পরে তাঁর উত্তরার বাসায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ভিড় করছেন। তবে তিনি কাউকে আশ্বাস না দিয়ে স্বভাবসুলভ ভাষায় দল যাকে ভাল মনে করেন তাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে বলে সবাইকে জানিয়ে দেন। সেই সঙ্গে এবারের নির্বাচন বিএনপির অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করে যে আসনে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হয় বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাসায় আগে দলের নেতাকর্মীরা তেমন যেতেন না। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে তার বাসা ও আশপাশের রাস্তায় প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ভিড় করছেন। সেখানে অন্যান্য অঞ্চলের দলীয় নেতাকর্মীরা গেলেও বৃহত্তর কুমিল্লাসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড় বেশি। এ ছাড়া সেগুন বাগিচায় তার ব্যবসা কেন্দ্র স্বজন টাওয়ারেও বিএনপি নেতাকর্মীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এর গুলশানের বাড়ি ও মতিঝিল অফিসেও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে দলীয় আইনজীবীদের মধ্যে যারা এবার বিএনপির টিকেটে নির্বাচন করতে চান তারাই বেশি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাসা ও অফিসে গিয়ে ভিড় করছেন। তাঁর অফিস ও বাসায় নোয়াখালী এলাকা থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাসা রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায়। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তার বাড়িতে গিয়ে ভিড় করছে। বিশেষ করে যুবদল ও ছাত্র দলের সাবেক নেতাদের মধ্যে যারা এবার বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সেখানে তাদের ভিড় বেশি। দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়ের পল্টন অফিসেও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়ে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য লবিং করছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়েই থাকেন সবসময়। গত এক বছর ধরে তিনি বাসায় যান না। তাঁর স্ত্রী মাঝে মধ্যে পার্টি অফিসে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যান। দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে বিএনপির আবাসিক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগে দলের আর কোন নেতা এভাবে বাসা ছেড়ে সারাবছর দলীয় কার্যালয়ে থাকেননি বলেই রিজভীকে আবাসিক নেতা বলা হচ্ছে। তাঁর কাছে এখন দিনরাত ২৪ ঘন্টাই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গিয়ে ভিড় করছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রুহুল কবির রিজভীর নিয়মিত যোগাযোগ হয় বিধায় তিনি ইচ্ছে করলে যে কারো মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই এমন ধারণা পোষণ করেন। আর এ কারণেই সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পরও রিজভী কখনও কখনও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পান। এ ছাড়াও দলে তারেকপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত ক’জন নেতার বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় বেড়েছে। দলের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। সব ক্ষমতা এরশাদের হাতে ॥ দলের নীতি নির্ধারণী সকল বিষয়ে একক ক্ষমতা জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের হাতে। তবুও দলে গুরুত্বপূর্ণ কলকাঠি নাড়েন রওশন এরশাদ। মঙ্গলবার গুলশানের একটি কনভেনশন সেন্টারে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাতকারের জন্য ডেকে ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কোন প্রার্থীর সঙ্গেই কথা বলেননি। তবে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেছেন, এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করবেন তিনি। এ নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না বলেও জানান সাবেক এই সেনা প্রধান। দলীয় আনুগত্যের কারণে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রত্যেকেই এরশাদের কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু অনেকর মধ্যেই এ নিয়ে ছিল ক্ষোভ, হতাশা। অনুষ্ঠান শেষে নেতাদের চায়ের আড্ডায় এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকর প্রশ্ন ছিল যদি একক সিদ্ধান্তে মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয় তাহলে কেন তাদের ডাকা হলো। ২ হাজার ৮৬৫ জন মনোনয়ন প্রত্যাশীর ফরম যাচাই বাছাই করে ডাকা হয়েছিল ৩০০জনকে। জাপার শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, দলের মূলত দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি রওশনপন্থী অপরটি এরশাদ পন্থী। বর্তমান সংসদের বেশিরভাগ সদস্যই রওশনপন্থী বলে জানা গেছে। এর কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে হঠাৎ করেই এরশাদ সকল নেতার মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন জাপার অনেকেই। এই ঘটনার পর থেকে এরশাদের দলে দুটি পক্ষ দৃশ্যমান। নির্বাচন সামনে রেখে যারা মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চান তারা স্বামীর-স্ত্রীর গ্রুপের আশির্বাদ নেয়ার চেষ্টা করছেন। জাপা সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফের মহাজোট করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে দলের পক্ষ থেকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়া সম্ভব হবে না। যারা যুগের পর যুগ কষ্ট করে দল করেছেন মহাজোটে নির্বাচন হলে ত্যাগী নেতারা মনোনয়ন বঞ্চিত হবেন। ফলে দল বদল বাড়বে। দুর্বল হবে জাতীয় পার্টি। জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য, একক নির্বাচনে করলে জাপার ফল ভালো হতো। জানা গেছে, জাপার বর্তমানে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ৩৬জন। সংরক্ষিত চারজন মিলিয়ে ৪০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে সংসদে বিরোধী দল। নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে এবারের নির্বাচনে কয়েকজন বাদ যেতে পারেন। তাছাড়া ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, সেনা কর্মকর্তারা নতুন করে দলে যোগ হওয়ায় পুরনো নেতাদের অনেকের মনোনয়ন পাওয়া অনিশ্চিত। তাই নতুন ও পুরনো সব মিলিয়ে মনোনয়নের টিকেট পেতে শেষ মুহূর্তে দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিদিন সাক্ষাত করছেন অনেকেই। দলের প্রধান এরশাদের সঙ্গে বাড়িধারার বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কে গিয়ে একান্ত সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। আবার গুলশান-২ নম্বরে রওশন এরশাদের বাড়িতেও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ভিড় দেখা যায়। সবার উদ্দেশ্য মনোনয়ন নিশ্চিত করা। বনানীতে এরশাদের রাজনৈতিক কার্যালয় রজনীগন্ধায়ও আছে তদবিরের দল। কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও তৃতীয় সাড়ির নেতাদের মনোনয়ন পেতে ভিড় দেখা যায়। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বোর্ডের অন্যতম সদস্য জি এম কাদের বলেন, মনোনয়ন নিয়ে একটি বোর্ড গঠন হয়েছে ঠিক। কিন্তু সবকিছু দেখভাল করবেন জাপা চেয়ারম্যান (এরশাদ) নিজেই। আমাদের কাছে কিছু পরামর্শ চাওয়া হলে আমরা সহযোগিতা করব। তিনি বলেন, সবার চাওয়া পাওয়া থাকা তো স্বাভাবিক। তাই অনেকে দেখা করতে আসবেন এটা মেনে নিতেই হবে। মনোনয়ন বোর্ডের অপর সদস্য রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, মনোনয়নের বিষয়ে সবকিছু দল প্রধান ঠিক করবেন। তবে নেতারা দাবি দাওয়া নিয়ে আমাদের কাছে আসবেন, তদবির করবেন এটা স্বাভাবিক। সর্বশেষ জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে ৭৬টি আসনের তালিকা দেয়া হয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, শরিক দলগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ৬৫-৭০টি আসন ছাড় দেয়া হবে। ইসলামী দলের চাওয়া ॥ এদিকে ইসলামী ঐক্যজোট প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে চারটি আসন চেয়ে তালিকা পাঠিয়েছে এগুলো হলো মাওলানা আবুল হাসানাত-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ বা ৩, মুফতি ফয়জুল্লাহ-চট্টগ্রাম-৪, আলতাফ হোসাইন-কুমিল্লা-১ এবং আবদুল লতিফ নেজামী-নরসিংদী-৩। মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ১৬ দল নিয়ে গঠিত ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্স চারটি আসন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে। এগুলো হলো লক্ষ্মীপুর-১ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল এমপি। এ্যালায়েন্সের কো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মিছবাহুর রহমান চৌধুরী এই আসনটি পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়াও ফরিদপুর-৪ আসনে জাকের পার্টির চেয়ারম্যান আটরশির পীরজাদা মোস্তফা আমির ফয়সল মোজাদ্দেদী, চাঁদপুর-৪ ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদেদ্দী। এ ছাড়াও শরিক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন মাইজভাণ্ডরী চট্টগ্রাম-২ ও ঢাকা-১৪ আসন চাওয়া হয়েছে। এসব আসনেও নিজের নাম নিশ্চিত করতে চলছে জোর লবিং। ১৪ দলেও লবিংয়ের শেষ নেই ॥ আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবার জোটের পরিধি বেড়েছে। ১৪ দলের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে যুক্তফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, নাজমূল হুদার জোটসহ কয়েকটি ইসলামী দল। তাই ১৪ দলে শরিকদের মধ্যে এবারের নির্বাচনে আসন কমার সম্ভাবনা বেড়েছে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্রিকেটার মাশরাফিকে যে আসনে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে সেই আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান সাংসদ মনোনয়ন পাচ্ছেন না। বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির সাতজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। ইতোমধ্যে দলটির পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষ হয়েছে। তবে দলের অন্তত ৩০ জন শীর্ষ নেতা নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২২৪টি আসনে জাসদ (ইনু) প্রার্থী ঠিক করেছে। কিন্তু দলটির বর্তমান সাংসদ ৬ জন। তবুও কেউ হাল ছাড়তে নারাজ। বড় নেতারা ইচ্ছামতো নিজেদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দল প্রধান ইনুসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যাচ্ছেন। ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্যের সংখ্যা ১৭জন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে সর্বোচ্চ ৪৫টি, ওয়ার্কার্স পার্টিকে ৪-৫টি, জাসদ দুই অংশকে সব মিলে ৫টি, তরিকতকে ১টি, জেপিকে সর্বোচ্চ ২টি, যুক্তফ্রন্টকে ৩-৪টি, জাকের পার্টিকে ১টিসহ অন্যান্য দলকে ২টি আসন ছাড় দেয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। মহাজোট শরিকদের কত আসন দেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের নেত্রী যেটা বলেছেন তা হলো ৬৫ থেকে ৭০টি আসন শরিকরা পাবেন। আলোচনা করে যদি মনে হয় উইনিবল প্রার্থী তাদের বেশি তাহলে সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্রী পার্টির ২৭, ওয়ার্কার্স পার্টির ৩০, জাসদ-ইনু-৩০সহ প্রায় শতাধিক আসনের তালিকা তৈরি করেছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। দু’পক্ষের আলোচনায় শেষ পর্যন্ত কত আসনে শরিকদের ছাড় দেবে আওয়ামী লীগ তাই এখন দেখার বিষয়। বিএনপির নেতারাও আসছেন কামাল হোসেনের কাছে ॥ ঐক্যফ্রন্টে এখন আলোচিত নেতা ড. কামাল হোসেন। গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা শুরুর পর রাজনীতিতে কদর বেড়েছে গণফোরামের। দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আমলারা যোগ দিচ্ছেন গণফোরামে। তাই নিজ দলের পক্ষে ৪৫ জনকে মনোনয়ন দিতে চান কামাল হোসেন। এর বাইরে ১০জন বিশিষ্ট নাগরিকদেরও তিনি আসন্ন সংসদে দেখতে চান। বিরোধী রাজনৈতিক জোটে এখন সবচেয়ে বড় অবস্থান কামাল হোসেনের। তাই তার রাজনৈতিক কার্যালয়, মতিঝিলের অফিসসহ বেইলি রোডের বাসায় আসছেন বিএনপিসহ ২০ দলের নেতারাও। মূলত মনোনয়ন নিশ্চিত করার তদবির করতেই নেতাদের আসা যাওয়া বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সবাই মনে করেন, কামাল হোসেন হলেন ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক। তাই কোন প্রার্থীর হয়ে তিনি বিএনপির কাছে সুপারিশ করলে মনোনয়ন নিশ্চিত। জানা গেছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব) ২৫, গণফোরাম-৪৫, নাগরিক ঐক্য-১৫, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ-১০ ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে আরও ৫ জনকে মনোনয়ন দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ১০ বিশিষ্ট নাগরিককে নির্বাচনে আনতে চান। এই তালিকাও ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, হোসেন জিল্লুর রহমান, রেজা কিবরিয়া, আইনজীবী শাহদীন মালিক, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আসিফ নজরুলসহ আরও কয়েকজন। তবে কৌশলগত কারণে তাদের নাম প্রকাশ করছেন না কামাল হোসেন। চার নেতার কাছে ভিড় ॥ এবার আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করবে বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। ইতোমধ্যে যুক্তফ্রন্টে ছোট বড় মিলিয়ে ৭৭টি রাজনৈতিক দল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ৩০টি আসন চায় যুক্তফ্রন্ট। তবে তালিকা হয়েছে ৪০ জনের। বি চৌধুরী ২০০১ সালের নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। এবার তিনি মুন্সীগঞ্জ-১ অথবা তিন আসনে মনোনয়ন চাইবেন। মাহী বি চৌধুরীকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে দেয়া হতে পারে। এছাড়া শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ আসন ও আব্দুল মান্নান নোয়াখালী-৪ ও ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন করতে পারেন। যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোর নেতারা মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। বি চৌধুরী, মাহী বি চৌধুরী, শমসের মবিন চৌধুরী ও মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের কাছে আসছে মনোনয়নের তদবির। তবে জনপ্রিয় নেতা দেখেই মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা।
×