ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উল্টো প্রত্যাবাসন ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশকেই চাপাচ্ছে মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের ভারি বোঝা রয়েই গেল বাংলাদেশের কাঁধে

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

 রোহিঙ্গাদের ভারি বোঝা রয়েই গেল বাংলাদেশের কাঁধে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন নির্যাতন যুগ যুগান্তরের। এই প্রক্রিয়ায় রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও ক্ষতবিক্ষত। নিপীড়ন প্রক্রিয়ায় মানবতা সেখানে বহু আগেই কবরস্থ হয়েছে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আসতে পারলেই আর যেতে চায় না। অতীতের রেকর্ড তাই বলে। সর্বশেষ আবার প্রমাণিত হলো সীমান্তের ওপারে অবিশ্বাসের রাহুগ্রাস আর এপারে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। এ প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর নির্ধারিত দিনে প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বসহ তাদের দাবি দাওয়া পূরণের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত ফিরতে চাইছে না। এর ফলে মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ যে বোঝা কাঁধে নিয়েছিল সেই বোঝা কাঁধেই রয়ে গেল। এই বোঝা থেকে বাংলাদেশ কখন ভারমুক্ত হবে তা অনিশ্চিত। তবে প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারার জন্য মিয়ানমার দায়ী করেছে বাংলাদেশকে। প্রসঙ্গত, অতীতে কয়েকদফায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কর্মসূচী কখনও পরিপূর্ণ সাফল্য পায়নি। উপরন্তু রোহিঙ্গা ঢলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল একেবারে জেরবার। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতের পর সীমান্ত গলিয়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার যে ঢল নেমেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পুরান-নতুন মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২ লক্ষাধিক। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছে ১১ লক্ষাধিক। এতেই প্রতীয়মান কত বড় বোঝা এখন বাংলাদেশের কাঁধে। সরকারকে এত বড় বোঝা বইতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক, সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রে কক্সবাজার অঞ্চলে বিপর্যয় ঘটেছে। তার ওপর প্রত্যাবাসন শুরু করা না যাওয়ায় আরও বহুমুখী বিপর্যয় ধাপে ধাপে যে নেমে আসছে তা স্পষ্ট। এরমধ্যে অন্যতম ঘটনা হচ্ছে এসব রোহিঙ্গা পরিবারে প্রতিমাসে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী নতুন শিশুর জন্ম নিচ্ছে আড়াই সহ¯্রাধিক। বহু পূর্ব থেকে আসা রোহিঙ্গারা এদেশের স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে যাওয়ার রেকর্ড গড়েছে। বর্তমানে যে ১২ লক্ষাধিক রয়েছে এরাও মূলত এদেশে থেকে যাবার অভিপ্রায় নিয়ে তৎপর। রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব মিয়ানমার সরকার কেড়ে নিয়েছে। সেটা তাদের ব্যাপার। বাংলাদেশ শুধু মানবিক কারণে তাদের প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় দিয়ে বাড়তি বোঝা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। মানবিক দিক দিয়ে সারা পৃথিবী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এখন প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বহু দেশ এই বোঝা বহনের অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশকে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের পক্ষে কি করে সম্ভব এত বড় বাড়তি বোঝা বহন করা। অথচ, বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা নিয়েই এ বোঝা বহন করে যেতে হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেলের দেশটিকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ১৫ নবেম্বর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পগুলোয় বিক্ষোভের উত্তাল ঢেউ যেন গর্জে উঠেছে। স্লোগান উঠেছে (আঁরা ন যাইয়্যুম) ‘আমরা যাব না।’ শর্ত দিয়েছে, নাগরিকত্বসহ বেশ কয়েকটি। যা বাংলাদেশের পক্ষে পূরণ করা কখনও সম্ভব নয়। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান একমাত্র বিশ্ব শক্তির হাতে। এই বিশ্ব শক্তিই বলে দিচ্ছে জোর করে কোন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা যাবে না। রোহিঙ্গারা এ বিষয়টি লুফে নিয়েছে। এদের ইন্ধন দিচ্ছে কিছু এনজিও সংস্থা এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অসংখ্য সংগঠন। যারা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কিছু দেশ থেকে আনছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। এই অর্থে এরা চালাচ্ছে নানা অপকর্ম। পাশাপাশি নেতৃত্বে যারা রয়েছে তারা গড়ছে বিত্তের পাহাড়। বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের শর্ত সাপেক্ষে অর্থাৎ যাচাই-বাছাই করে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতিতে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ঘুমধুমের জিরো পয়েন্টে মিয়ানমার পক্ষ প্রত্যাবাসিত হবে এমন রোহিঙ্গাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের একজনও ফিরে যায়নি। আরআরসিসহ এদেশের প্রশাসনযন্ত্র সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন বিকেলেই বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে জানান দিয়েছেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে না। ফলে রোহিঙ্গারা এদেশে থাকার ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে গেল। এর বিপরীতে নানাবিধ কারণও রয়েছে। যারমধ্যে রয়েছে তাদের নিজ দেশে নিজেদের নাগরিকত্ব নেই, অবাধ চলাফেরার সুযোগ নেই, বাপ দাদার ভিটেমাটির অস্তিত্ব নেই। সবই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে বুলডোজারের মাটিচাপায় একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এ দায় মিয়ানারের। মিয়ানমারকেই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অবিশ্বাসের যে ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে তার অবসান ঘটাতে হবে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে আসার পর বছর শেষে মিয়ানমার পক্ষ জানান দিয়েছে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। ফিরে যাবার ছয়মাস পর রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের আবেদনও করতে পারবে। কিন্তু অতীতে দফায় দফায় বিশ্বাস ভঙ্গকারী মিয়ানমার পক্ষের এমন কথায় রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা স্পষ্টভাবে জানান দিয়েছে, বিদেশীদের অবাধ চলাফেরা রাখাইন রাজ্য জুড়ে নিশ্চিত করার পর তারা যখন ইতিবাচক তথ্য জানান দেবে তারপরই তারা প্রত্যাবাসনে অংশ নেবে। রোহিঙ্গারা এমনও বলেছে, নাগরিকত্ব দেয়া হলে তারা একদিনেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে। এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে এবং নিয়মিত ত্রাণ সহায়তা নিয়ে জীবনযাপন করছে এমন সুবিধা মিয়ানমার আদৌ তাদের দেবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পক্ষে সুবিধাজনক অবস্থান কখনও তৈরি করবে না। যেখানে রোহিঙ্গা নিধন মিয়ানমার সরকারের নীলনক্সার একটি অংশ সেটাই তারা ধাপে ধাপে পূরণ করে চলেছে। অতীতের মতো আগামীতেও যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন আবারও চলবে না তা নিয়ে তাদের মাঝে যে শঙ্কা ঘনীভূত হয়ে আছে তা দূরীকরণ তত সহজ নয়। এসব ঘটনায় মূলত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বিমুখ করে রেখেছে। এদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’দেশের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত তারিখে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্থানীয়রা। প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ার পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, তা খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন তারা। স্থানীয়দের পক্ষে বলা হচ্ছে, কিছু এনজিও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন প্রত্যাবাসনবিরোধিতায় নেমে রোহিঙ্গাদের উস্কে দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসনের দিনে বিক্ষোভরত রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে ইংরেজীতে লেখা শয়ে শয়ে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন প্রমাণ করে এর নেপথ্যে শক্তিশালী মহল তৎপর রয়েছে। অশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে এ জাতীয় ইংরেজী অক্ষরে ব্যানার প্রস্তুত সম্ভব নয়। এতে করে বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের কাঁধে এ বোঝা চাপিয়ে রাখতে বহু মহল তৎপর। উল্টো বাংলাদেশকেই দায়ী করছে মিয়ানমার ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারায় বাংলাদেশকেই দায়ী করছে মিয়ানমার। বৃহস্পতিবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ট থো রাজধানী নেপিডোতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দোষারোপ করেছেন। বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রত্যাবাসন তালিকায় যাদের নাম ছিল তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জানানো হয়নি। মিন্ট থো দাবি করেছেন, দুই দেশ যে বিষয়টিতে ঐকমত্য হয়েছিল, বাংলাদেশ সেই আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কর্মসূচী মেনে চলা হয়েছিল। মিয়ানমার সরকারের ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া উত্তর রাখাইনের তিন ধরনের লোক আছে। এদের একাংশ মিয়ানমারে ফিরতে চায় না বরং তারা তৃতীয় কোন দেশে যেতে চায়, আরেকাংশ গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতায় জড়িত ও ফিরতে চায় না এবং তৃতীয় অংশটি হচ্ছে যারা মিয়ানমারে স্বজনদের কাছে ফিরতে চায়। মিন্ট থো বলেন, প্রথম দুই ধরনের শরণার্থী ফিরতে চায় না। আমরা অবশ্যই যাচাইকৃত শরণার্থীদের চুক্তি অনুযায়ী গ্রহণ করব। তবে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সদস্য ইউ আয়ে লিউন জানিয়েছেন, শরণার্থীদের ফেরাটা যে তাদের জন্য নিরাপদ হবে সেটা মিয়ানমারকে প্রমাণ করতে হবে। তিনি বলেন, নিজের দেশে ফিরতে চায় না এমন কেউ নেই। প্রত্যেকেই নিজের মাতৃভূমিতে ফিরতে চায়। সরকার যদি শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও জীবিকার নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে সমস্যাটি সহজ হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, চুক্তি অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ১৫০ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। তবে ওসব রোহিঙ্গা রাজি না হওয়ায় তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।
×