ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন ছুটে চলে আপন গতিতে ॥ পিটার ডিঙ্কলেজ

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

জীবন ছুটে চলে আপন গতিতে ॥ পিটার ডিঙ্কলেজ

যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩তম এ্যামি এ্যাওয়ার্ডসে ৪৩ বছর বয়সী পিটার ডিঙ্কলেজ শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মূলত জনপ্রিয় মার্কিন নাটক ‘গেম অব থ্রোনস’-এ টাইরিওন ল্যানিস্টার চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এই পুরস্কার জেতেন। বলা যায়, মাত্র ১৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার পিটার ডিঙ্কলেজ হলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় একজন অভিনেতা। ডিঙ্কলেজ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন আর মা ছিলেন গানের শিক্ষক। তার মা-বাবার উচ্চতা স্বাভাবিক মানুষের মতোই। জিনগত সমস্যার কারণে জন্ম থেকে ডিঙ্কলেজ এক ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে তিনি অন্য শিশুর মতো লম্বা হওয়ার সুযোগ হারান। এই গুণী কাজ করেছেন এক্সম্যান : ডেইজ অব ফিউচার পাস্ট, দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া : প্রিন্স ক্যাসপিয়ানের মতো চলচ্চিত্রে। চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি এরই মধ্যে জিতে নিয়েছেন গোল্ডেন গ্লোব, প্রাইমটাইম এ্যামি এ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার। পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেনিংটন কলেজে নাট্যকলায়। মা বাবার যতেœ দিন দিন বড় হয়ে ওঠেন ডিঙ্কলেজ। কৈশোরে প্রবেশের পর অনেকটা পরিবর্তন হয় তার মাঝে। তিনি তামাক খেতে শুরু করেন। তবে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি উপলব্ধি করতে শেখেন এবং ধীরে ধীরে হাস্যরস এবং বিনয়ী আচরণের মাধ্যমে নিজের উচ্চতা সমস্যা মোকাবেলা করেন। আসলে অনেকেই ছোটবেলায় ডিঙ্কলেজের মতো নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ সবাই নিখুঁত বা নির্ভুল নয়। অনেকের শরীরেই নানা রকম ত্রুটি থাকে। কেউ কেউ নিজের ত্রুটি নিয়ে মাঝেমাঝে খুব খারাপ বোধ করেন। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। একবার তথ্যমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নিজের ছোটবেলার অনুভূতি সম্পর্কে ডিঙ্কলেজ বলেন, আগে আমি নিজের উচ্চতা নিয়ে কষ্ট বোধ করতাম। তবে বড় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি, উচ্চতা কোন সমস্যা নয়। অন্যরা কীভাবে আমাকে দেখেন, তা আমার সমস্যা নয়। আমি অন্যদের জন্য বাস করতে চাই না। আমরা প্রায় সময়ই বলতে শুনি, জীবনে একটি দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি দরজা খুলতে থাকে। জীবন থেমে থাকে না, ছুটে চলে আপন গতিতে। ছোটবেলা থেকেই ডিঙ্কলেজের মধ্যে অভিনয়ের প্রতিভা দেখা দেয়। স্কুলজীবন শেষ করার পর ডিঙ্কলেজ একজন অভিনেতা হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভর্তি হন বেনিংটন কলেজে। সেখানে থিয়েটার বিভাগে লেখাপড়া করেন। স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার পর প্রথমে একজন চিত্রনাট্যকার ও পরে একজন অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে ডিঙ্কলেজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুব মসৃণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় কোন চাকরি খুঁজে পাননি। তিনি বিষণœতার দিকে চলে যাচ্ছিলেন। দিন দিন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। তাই বলে অভিনয়ের প্রতি ডিঙ্কলেজের আগ্রহ কখনও কমে যায়নি। ১৯৯৫ সালে তিনি অভিনয়ের একটি সুযোগ পান। তবে এই সুযোগ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেনি। তার পর খুব লম্বা সময় তিনি এমন কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যে সব চলচ্চিত্র তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, বক্স অফিসও তেমন ভাল নয়। ৮ বছর পর তিনি ‘দ্য স্টেশন এজেন্ট’ নামের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটিতে ডিঙ্কলেজের অভিনীত চরিত্র ছোটখাটো ফিনবার অন্যদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য জনভিড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একমাত্র ভাল বন্ধু মারা যাওয়ার পর তিনি পরিচিত পরিবেশ থেকে সরে যান। সেখানে তিনি দু’জনের সঙ্গে দেখা করেন। এ দু’জনের একই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। তারা তিনজন দিন দিন বন্ধু হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ফিনবার যেন বাস্তব জীবনের ডিঙ্কলেজের মতো। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি হলিউডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ২০১২ সালে তিনি তার নিজের কলেজ বেনিংটন কলেজে ফিরেছিলেন সমাবর্তন বক্তা হয়ে। নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরেন এভাবেÑ বন্ধুরা আমার শুরুটা হয়েছিল এক বৃষ্টিস্নাত রাতে। সেটা ১৯৮৭ সালের কথা। আমি ছিলাম একজন সম্ভাবনাময় ছাত্র। স্নাতকেরা, তোমরা আজ যেখানে বসে আছ, ঠিক এই জায়গায় যখন আমি বসেছিলাম, আমার চোখে হাজারো স্বপ্ন ছিল। কোথায় যাব, কী হব, কী করব, সহপাঠীদের সঙ্গে কীভাবে একটা থিয়েটার চালু করব, কোন ছবিতে অভিনয় করব, কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করব, কী গল্প বলব... কত স্বপ্ন। ভাবতাম একটু হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু এই সব স্বপ্ন একদিন না একদিন পূরণ হবে। ২২ বছর আগে তোমাদের আসনে বসে আমি সব ভাবতাম, শুধু ভাবতাম না কাল কী হবে? কাল আমি কী করব? স্নাতক শেষ হলো ১৯৯১ সালে, দারুণ একটা বছর। তখন আমার টাকা ছিল না, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছিল না, ক্রেডিট কার্ড ছিল না, এ্যাপার্টমেন্ট ছিল না। ছিল শুধু ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা। নয়টা-পাঁচটা চাকরি আমি চাইনি। আমি ছিলাম একজন অভিনয়শিল্পী, একজন লেখক। বেনিংটনের স্নাতক। তবু আমাকে একটা চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। পাঁচ মাস একটা পিয়ানোর দোকানে পিয়ানোর ওপর থেকে ধুলা ঝেড়েছি। একজন শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞের সম্পদের দেখভাল করেছি। কিছুদিন বেকারও ছিলাম। নানা রকম কাজের পর অবশেষে প্রফেশনাল এক্সামিনেশন সার্ভিস নামে একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকলাম ‘ডেটা এন্টারার’ হিসেবে। সেখানেই ছিলাম টানা ছয় বছর। ছয় বছর! বেনিংটনে যতটা সময় কাটিয়েছি, তার চেয়েও বেশি! ২৩ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে সেখানে। তারা আমাকে পছন্দ করত। মজার মানুষ ছিলাম। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম, কারণ আগের দিন আমাকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কাজটা আমি ভীষণ অপছন্দ করতাম। তবু সেই চাকরিটাই আঁকড়ে ধরে ছিলাম। কারণ, এই চাকরি আমাকে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল। ব্রুকলিনের একটা কারখানার চিলেকোঠায় ছোট্ট ঘরে থাকতাম। রাস্তার ওপারেই ছিল একটা আগুন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমন সব রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হতো, যেগুলো রাসায়নিক থেকে সৃষ্ট আগুন নেভাতে সক্ষম। বাতাসে ভেসে বেড়াত রাসায়নিক দ্রব্যের কণা, তাতে আমার খুব একটা সমস্যা হতো না। কারণ, রাস্তার পাশে একটা মসলার কারখানা ছিল। সেখান থেকে ভেসে আসা জিরার ঘ্রাণে অন্য সব গন্ধ চাপা পড়ে যেত। ঘরে ইঁদুর ছিল, তাতেও আমার সমস্যা ছিল না। কারণ, আমার একটা বিড়ালও ছিল। বিড়ালটার নাম ব্রায়ান। একটাই জানালা ছিল ঘরে। জানালার উচ্চতা আমার চেয়ে বেশি বলে উঁকি দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা দেখতে পেতাম না। ব্রায়ানই আমাকে বাইরের পৃথিবীর গল্প বলত। সেখানে আমি ১০ বছর ছিলাম। না কেউ করুণার চোখে তাকিয়ো না। গল্পের শেষটা আনন্দের। ২৯ বছর বয়সে ঠিক করলাম, সামনে যেখানেই অভিনয়ের কাজ পাব, লুফে নেব। টাকার অঙ্ক যতই হোক না কেন। ভাল হোক, খারাপ হোক, আমি অভিনেতাই হব। অতএব আমি প্রফেশনাল এক্সামিনেশন সার্ভিসকে বিদায় জানালাম। আমার বন্ধুরা এ ব্যাপারে খুব একটা খুশি ছিল না। কারণ, যত দিন আমি চাকরি করতাম, তত দিন আমাকে খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ছিল। কাজের জায়গায় এলেই পাওয়া যেত। ইমপারফেক্ট লাভ নামে একটা মঞ্চনাটকে কাজ করার সুযোগ পেলাম। পরে এই গল্প থেকে চলচ্চিত্র হলো, নাম থার্টিন মুনস। এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্র, আরেক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলাম। আমি কিন্তু জানতাম না, এমনটা হবে। ২৯ বছর বয়সে যখন ‘ডেটা প্রসেসিং’-এর কাজ ছেড়ে আসছিলাম, খুব ভীত ছিলাম। ১০ বছর একটা খুপরির ভেতর থেকেছি, ছয় বছর এক চাকরি করে গেছি। আমি হয়ত পরিবর্তনকে ভয় পাচ্ছিলাম। তোমরাও পাও, তাই না? আমার মা-বাবার অত টাকা ছিল না। কিন্তু আমাকে সেরা স্কুলে পাঠাতে তাঁরা ভীষণ কষ্ট করেছেন। স্নাতকেরা, তোমাদের হয়ত কথাটা শুনতে ভাল লাগবে না, স্নাতক শেষ করার পর আমার দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। নিজের আয়ে নিজে চলতাম।
×