ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৭ দফা দাবিতে রাজপথের কর্মসূচী জোরদারের প্রস্তুতি

সংলাপে সুবিধা না হওয়ায় বিএনপি হতাশ

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩ নভেম্বর ২০১৮

 সংলাপে সুবিধা না হওয়ায় বিএনপি হতাশ

শরীফুল ইসলাম ॥ সংলাপে সুবিধা আদায় করতে না পারায় বিএনপি শিবিরে হতাশা নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে আর সংলাপের আশায় বসে না থেকে ৭ দফা দাবিতে রাজপথের কর্মসূচী জোরদারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৬ নবেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্যফ্রন্টের জনসভা থেকে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করতে বিএনপির পক্ষ থেকে চাপ বাড়ছে। কোন কারণে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন কঠোর আন্দোলন কর্মসূচীর পক্ষে সায় না দিলে বিএনপি ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করবে। উল্লেখ্য, গণভবনের সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দাবির মধ্যে তিনটি দাবির আংশিক বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। এর মধ্যে রয়েছে এখন থেকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে, বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়া হবে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নামে হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের তালিকা দিলে তদন্ত সাপেক্ষে বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন। সংলাপকালে ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফায় থাকা অধিকাংশ বিষয়গুলোই সংবিধান, আদালত ও নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বলে এসব বিষয়ে সমাধান দেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নির্বাচনের তফসিল পেছানো এবং নির্বাচনকালে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে ১৪ দলের পক্ষ থেকে ঐক্যফ্রন্টকে আশ্বস্ত করা যায়নি। সূত্র মতে, ১ নবেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত দুই জোটের ৪৩ নেতার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার সংলাপে ৭ দফার অধিকাংশ পয়েন্টে কোন সমঝোতা না হওয়ায় বিএনপি কোন আশার আলো দেখতে পায়নি। আর এ জন্যই সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংলাপে আমরা সন্তোষ্ট নই’। যদিও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা বলেছেন সংলাপ ভাল হয়েছে। অবশ্য তিনি এও বলেছেন, সংলাপে বিশেষ কোন সমাধান আসেনি। তবে সংলাপ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন ও জাসদ সভাপতি আসম আব্দুর রব বলেছেন, একদিনের সংলাপে সবকিছু পাওয়া যায় না। তার মানে তারা পরোক্ষভাবে আরও সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি আর সংলাপ করে সময় নষ্ট করতে চায় না। সংলাপের আগে বৃহস্পতিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপি আয়োজিত মানববন্ধনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা বলেছেন খালেদা জিয়াকে ছাড়া তাদের দল নির্বাচনে যাবে না। ১৪ দলের সঙ্গে সংলাপেও তারা বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু সংলাপে এ বিষয়ে কোন সফলতা অর্জন করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীসহ ১৪ দলের নেতারা আদালতের বিষয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হওয়া মামলার বিষয়ে কিছু করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। মূলত এ কারণেই সংলাপ শেষে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ভর করে। শুক্রবার নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার অনমনীয় মনোভাব দেখাতে থাকলে সংলাপ নয়, মাথা উঁচু করে ৭ দফা দাবি রাজপথেই আদায় করা হবে। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর একগুয়েমি মনোভাব গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বড় ধরনের অশনিসংকেত। তাই সংলাপ নিয়ে মানুষের মনে যে আশা জেগে উঠেছিল, সংলাপ শেষে সেই আশার মুকুল ঝরে যেতে শুরু করেছে। সংলাপে ৭ দফা দাবির প্রতি সাড়া না দেয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচনের অগ্রগতি তিমিরাচ্ছন্ন হলো। বিএনপি সূত্র জানায়, সংলাপকালে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আশ্বাস পেলে ৭ দফায় থাকা অন্য দাবিগুলোর বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নমনীয় থাকত। আর এ কারণেই বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের অধিকাংশ নেতা বার বার খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে এনেছেন। যদিও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সংলাপে কোন কথা বলেননি। ড. কামাল হোসেন আবারও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের আগ্রহ প্রকাশ করলেও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কোন আশ্বাস না পেলে বিএনপি নেতারা আর সংলাপে যাবে না বলে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে সংলাপে সফলতা আসবে না এমন আশঙ্কা করে ২১ জনের নামের তালিকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নাম থাকার পরও তিনি গণভবনে যাননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যদিও সংলাপের আগে গয়েশ্বর অসুস্থ বলে যেতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। জানা যায়, সংলাপ করে দাবি আদায় করা যাবে না বলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বিএনপির আরও ক’জন সিনিয়র নেতা আগেই দলের হাইকমান্ডকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতার আগ্রহে শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি গণভবনের সংলাপে গিয়েছে। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গণভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানোর পরও সে আমন্ত্রণে সাড়া না দেয়ায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে সমালোচনার মুখে পড়ে ছিল এবার যাতে সে অবস্থা না হয় সেজন্যই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে যায় বিএনপি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় সংলাপকালে প্রধানমন্ত্রী ও ড. কামাল হোসেনের সূচনা বক্তব্যের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং এসব দাবি আদায়ে প্রধানমন্ত্রীসহ ১৪ দলের নেতাদের সহযোগিতা চান। উত্থাপিত দাবিগুলো শুনার পর প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেন সংবিধানের বাইরে গিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই। তবে সংবিধান, আদালত ও নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে যদি কোন বিষয় থাকে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে সভা-সমাবেশ করার বিষয়ে সবাই সমান অধিকার পাবে। তবে রাস্তা বন্ধ করে কেউ সমাবেশ করতে পারবে না। নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে মাঠে সমাবেশ করা যাবে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নির্দেশ দেয়া হবে। সংলাপের এক পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন নির্বাচনকালে মেজিস্ট্রেসি দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়নের বিষয়টি উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি তো নির্বাচন করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচন ছাড়া আর কোন নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল না। তাহলে এখন কেন চান? তবে নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষক থাকার বিষয়ে কোন আপত্তি নেই বলে প্রধানমন্ত্রী জানান। এছাড়া তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সংলাপে অংশ নেয়া সবাইকে আশ্বস্ত করেন। জানা যায়, সংলাপ শেষ হওয়ার পর এর সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে ইতোমধ্যেই দলের সর্বস্তরে আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই এ সংলাপের ফলাফল দেখে চরম হতাশ হয়েছে। এ কারণে আর সংলাপ না করে রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা আগ্রহ প্রকাশ করে। আর এ কারণেই বিএনপি এখন আন্দোলনের পথেই যাচ্ছে। যা শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেই দিয়েছেন। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার গণভবনে সংলাপ শেষে বিএনপির সিনিয়র নেতারা লন্ডনপ্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারেক রহমান সংলাপের ফলাফল জেনে নেতাদের আন্দোলন জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ নির্দেশনা পেয়ে ইতোমধ্যেই দলের বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। এদিকে ৬ নবেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যে জনসভা হওয়ার কথা সেখান থেকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। যদিও ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি ছাড়াও গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য ও জাদস জেএসডি) রয়েছে তবুও সবাইকে প্রভাবিত করে কিভাবে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা যায় সে জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জনে জনে কথা বলা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে যেহেতু এ জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন তাই শেষ পর্যন্ত ৬ নবেম্বরের জনসভা থেকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণার ক্ষেত্রে বিএনপি সফল হয় কি না এখনও নিশ্চিত নয়।
×