ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

মামুনুর রশীদ-নাসিরউদ্দিন ইউসুফের আলাপনে মুগ্ধ নাট্যকর্মীরা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৬ অক্টোবর ২০১৮

মামুনুর রশীদ-নাসিরউদ্দিন ইউসুফের আলাপনে মুগ্ধ নাট্যকর্মীরা

গৌতম পান্ডে ॥ নাট্যপ্রেমীদের জন্য মুহুর্তটি ছিল আনন্দের, অজানাকে জানা আর সংস্কৃতিজনের স্মৃতিবাক্যে বিনোদিত হওয়ার শুভক্ষণ। দুজনই বিদগ্ধ নাট্যপুরুষ। দুজনই নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতাসহ বহু গুণে গুণান্নিত। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে মেঠো আল পথ থেকে যারা বিগত ৪৭ বছর ধরে রক্ত, ঘাম ও শ্রম দিয়ে আজ রাজপথে পরিণত করেছেন সেই অগ্রজ নাট্যজনদের অন্যতম মামুনুর রশীদ ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। এ দুজন শোনালেন বাংলা নাটকের উত্থান ও বিস্তারের কথা। কোন কথাই কাল্পনিক নয়, বাস্তবতার নিরীক্ষে নাট্যান্দোলনের স্মৃতিকথায় মুগ্ধ করলেন মিলনায়তনভর্তি নাট্যকর্মী দর্শক-শ্রোতাকে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিলেন দুজনে সাবলীলভাবে। নাটক সরণির (বেইলি রোড) মহিলা সমিতির আইভি রহমান মিলনায়তনে শুক্রবার সকালে প্রথমবারের মতো ব্যতিক্রমধর্মী এই আলাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মঞ্চ নাটক নির্দেশকদের সংগঠন ‘থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটি’। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘তিন প্রজন্মের নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, নাট্যজন ও দর্শকের মুখোমুখী আলাপনে নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ’। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখে এতদিন মুগ্ধ হয়েছে যে দর্শক, এবার দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের কথায় মুগ্ধ হলেন সবাই। যাতে শিল্প ও নাট্য আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেন দেশের এই দুই নাট্যব্যক্তিত্ব। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন প্রজন্মের নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, নাট্যজন ও দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দিতে গিয়ে নাট্যব্যক্তিত্বদ্বয় তাদের নাট্য জীবন ও সৃজনশীল কাজের নানা দিক তুলে ধরেন। আলাপনের শুরতেই ৬০ দশকের নাট্য ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে আলোকপাত করেন দুই নাট্যব্যক্তিত্ব। পরে, আলাপনের ধারাবাহিকতায় তাদের কথায় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের নাট্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রসঙ্গ উঠে আসে। যার প্রথমেই কথা বলেন নাট্যকার, নিদের্শক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ষাটের দশকে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট খুব চমৎকার ছিল। সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, ছাত্র রাজনীতি এবং রাজনীতি যারা করতেন তাদের সঙ্গে মিল ছিল। যেটা এখন আর নেই। এখন যিনি রাজনীতি করেন সংস্কৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। ষাটের দশকে এই যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকেই। এই সম্পর্ক না থাকার কারণেই এক ধরনের শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এগুলো রাজনীতিতে উত্থান হচ্ছে। তখন আমরা যারা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কাজ করি, তাদের বলা হতো কবিতা, স্লোগান, পোস্টারসহ নানা বিষয় লিখে দিতে। আমাদের নাট্য সংস্কৃতির একটা বড় উপাদান হিসেবে দেখা দিল উৎসব। ঢাকা তো বটেই, ঢাকার বাইরেও প্রচুর নাট্যোৎসব হতো। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলা শহরগুলোর সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হতো। রাজনৈতিক থিয়েটারের একটা বড় দিক হলো পথ নাটক। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, আমরা যে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি তা পঞ্চাশের দশক থেকে আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করে। যাটের দশকে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। পঞ্চাশের দশকে মওলানা ভাষানী এবং ষাটের দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এর পূর্ণতা পায়। একদিকে ছায়ানট, অন্যদিকে নাটক, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক নাটক এর সহযোগী হয়ে ওঠে। তখন আমরা রাজধানীর নবাবপুরে মাঝে মধ্যে নাটক করতাম। তখন নাট্য আন্দোলনের মিছিলে ছিলাম। কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কবি নির্মলেন্দু গুণ একদিন বললেন, আপনার দ্বারা কবিতা হবে না। আশাহত হয়ে ছেড়ে দিলাম। অবশ্য পরবর্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি কবিতা লিখেছিলাম। মামুনুর রশীদের সঙ্গে আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সরাসরি পরিচয় ছিল না। রেডিও টেলিভিশনে ওনার কণ্ঠস্বর ছিল ভিন্ন। সে জন্য এক ধরনের আকর্ষণ তার প্রতি আমাদের মত তরুণদের ছিল। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে মামুন ভাই ও আমার একই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ছত্র ছায়ায় হলেও ভবিষ্যতে তেমন ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ড্রামা সার্কেল। ছেষট্টিতে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে নগর কেন্দ্রীক নাট্যচর্চা শুরু হয়। ষাটের দশকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠন। শিল্পীদেরই সংগঠন ছিল এটি। পরাধীন দেশে সংস্কৃতিকর্মীরা যে বীজটি বপন করায় সক্ষম হয়েছিল সেটা হচ্ছে যে দেশটি স্বাধীন হবে, সেটি যদি বাংলাদেশ হয়, সেটি অবশ্যই মানুষের সমঅধিকারের দেশ হবে। সমাজতন্ত্রের যে ভাবনা শিল্পীদের মধ্যে ছিল তা রাজনীতিতে সফলভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এটি ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি বড় জায়গা।
×