ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে বাস্তবায়ন হচ্ছে তিন লাখ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৫ অক্টোবর ২০১৮

কক্সবাজারে বাস্তবায়ন হচ্ছে তিন লাখ কোটি টাকার প্রকল্প

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাপক উন্নয়নে পাল্টে যাচ্ছে কক্সবাজারের চেহারা। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের ব্যাপক উন্নয়ন দেখে স্থানীয় জনগণ ছাড়াও মুগ্ধ বিদেশী পর্যটকরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে কক্সবাজারের প্রতি। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে উন্নত ও পরিপূর্ণ পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে সৈকত রানী কক্সবাজারকে। জানা যায়, দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় কক্সবাজারেও বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ৬৯টি প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগা প্রকল্প রয়েছে ১২টি। যেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে কক্সবাজারের চেহারা। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারকে একটি উন্নত ও পরিপূর্ণ পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে। তাই বর্তমান সরকার পরিকল্পিতভাবে সৈকত নগরী কক্সবাজারে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড, ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প, সাবরাং এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মহেশখালী উপজেলায় চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, জালিয়ারদ্বীপ এক্সক্লুসিভ নাফ ট্যুরিজম পার্ক, হাইটেক পার্ক নির্মাণ, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে এগিয়ে যাবে কক্সবাজার। ওসব প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে কক্সবাজারের আয় থেকে (রাজস্ব) জাতীয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ যোগান হবে। জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, চট্টগ্রামের দোহাজারী হতে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া-রামুু হয়ে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত প্রায় ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলার ৩৩টি মৌজার প্রায় ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের জন্য চকরিয়া, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৩টি এলএ কেসে অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। ২০২০ সালের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্ক ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হবে বাংলাদেশের রেলপথ। এ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান হয়ে যাবে ইউরোপের তুরস্ক পর্যন্ত। কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণে বিমান বন্দর সম্প্রসারণের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান এই সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কক্সবাজার বিমান বন্দর এমনভাবে উন্নয়ন করা হবে, যেন বোয়িং ৭৭৭ অথবা এয়ার বাস ৩৪০ এর মতো বিশাল আকৃতির বিমান সহজেই উঠানামা করতে পারে। সবদিক থেকেই এই বিমান বন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সদরের খুরুশকুলে ৪ হাজার ৪০৯টি ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ছোট-বড় আরও বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। জালিয়ার দ্বীপের ২৯১ একর জায়গার মধ্যে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে উঠছে। পার্কটি সফলভাবে সম্পন্ন হলে পর্যটন খাতে উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বেজা বলছে, দৃষ্টিনন্দন এ পার্কটিতে পর্যটকদের সুবিধার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হবে। হোটেল, কটেজ, ইকো-ট্যুরিজম, ৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ভাসমান জেটি, ঝুলন্ত সেতু, শিশু পার্ক, ইকো কটেজ, ওসানোরিয়াম- মেরিন এ্যাকুয়ারিয়মের ব্যবস্থা রাখা হবে। এছাড়া আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ বিনোদনের সব সুবিধার ব্যবস্থাও থাকবে সেখানে। দেশের সর্বদক্ষিণে টেকনাফের সাগর তীরে মোট এক হাজার ৪১ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। পার্কটিতে পাঁচ তারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন এ্যাকুরিয়াম, সি-ক্রুজ, বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওসানেরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা বিনোদনের সুবিধা রাখা হবে। মহেশখালীর সোনাদিয়ায় হচ্ছে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক। মোট ৯ হাজার ৪৬৭ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে ওই পার্কটি। পরিবেশবান্ধব হিসেবে পার্কটি গড়ে তুলতে প্রাথমিকভাবে মোট জমির ৩০ শতাংশ জায়গা ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এখানে বসবাসরত ৩৩৩টি পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে বেজা কর্তৃপক্ষ। সোনাদিয়া দ্বীপে নতুন করে যাতে মৎস্য ঘের ও অবৈধভাবে বসতি গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। দ্বীপের জীব- বৈচিত্র্য বজায় রেখে পরিবেশ-বান্ধব ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তুলতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। দ্বীপের উপকূলীয় অংশে ঝাউবন সৃজনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল স্থাপনে কাজ করছে। সুপেয় পানি নিশ্চিতকল্পে কাজ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। এছাড়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কে কয়েকটি অত্যাধুনিক আবাসিক কটেজ ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও অবৈধ দখল বন্ধে পুলিশ ক্যাম্প এবং সশস্ত্র আনসার নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারী সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার, কোরিয়ান টেলিকম ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ডিজিটাল আইল্যান্ড-মহেশখালী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকভাবে মহেশখালী উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন যথা মহেশখালী পৌরসভা, বড় মহেশখালী ও ছোট মহেশখালীর ২৫টি সরকারী অফিসকে হাই-স্পিড অনলাইন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও ই-কমার্স এই ৪টি সেক্টরের সকল সেবা ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব হবে। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মধ্যমে পাঠদান, দূর শিক্ষা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রহণ করা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে টেলি-মেডিসিন, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় কার্যক্রম। এছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য ই-কমার্স প্লাটফরম স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ির ওই বিদ্যুত কেন্দ্র বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রকল্প। বিদ্যুত নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনায় মাতারবাড়িকে ‘বিদ্যুত হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় যে বন্দর নির্মাণ করা হবে, পরে তাকে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তরিত করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ৫৯ ফুট গভীর এ বন্দরে ৮০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। জাপানের তোশিবা কর্পোরেশন এ বন্দরটি নির্মাণ করবে। সরকার আশা করছে, বিদ্যুত কেন্দ্র ও দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে মাতারবাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে বিদ্যুত প্রকল্পটির প্রাথমিক অবকাঠামোর কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিদ্যুত কেন্দ্রে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) এর অধীনে নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়িতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এই প্রকল্পে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা-জাইকা। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হবে। অবশিষ্ট অর্থের যোগান দেবে কেন্দ্রটির বাস্তবায়নকারী ও স্বত্বাধিকারী সিপিজিসিবিএল। এছাড়াও মহেশখালীতে স্থাপন করা হয়েছে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল। ইতোমধ্যে এ টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। এলএনজি জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে সরবরাহের জন্য দ্রুত উপকূল থেকে আনোয়ারা এবং আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত দুই ভাগে ১২১ কিলোমিটারের দুটি পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে জ্বালানি বিভাগ। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবি কর্তৃক এক হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। গত ৬ মে সেটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন তিনি বাঁকখালী সেতু, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অফিস ভবন, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রামুর আইটি পার্ক, এলএনজি টার্মিনাল, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম), নাফ ট্যুরিজম পার্ক, উখিয়া বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজের একাডেমিক ভবন ও কুতুবদিয়া কলেজের একাডেমিক ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এসব প্রকল্প ছাড়াও কক্সবাজার জেলার পেকুয়া মগনামায় সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ, রামুর নোনাছড়িতে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আওতায় ক্রীড়া স্কুল নির্মাণ হচ্ছে।
×