ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যা-সমাধান সুদূরপরাহত!

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রোহিঙ্গা সমস্যা-সমাধান সুদূরপরাহত!

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের অনীহা ও কালক্ষেপণের বিষয়টি বহু পুরনো। এ প্রক্রিয়ায় ১৯৭৮ সালে রাখাইন থেকে দমন নিপীড়নের মুখে চলে আসা ৩৩ হাজার রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে প্রত্যাবাসনের মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে মিয়ানমার। এই ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তান মিলে এখন তা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার। এ পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের। রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব দরবারে সোচ্চার ভূমিকায়। কিন্তু মিয়ানমার ব্যস্ত কালক্ষেপণে। তাদের দৃশ্যমান ভূমিকা রহস্যজনক। প্রত্যাবাসনের চুক্তি করেও তা শুরু করছে না। আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে তা সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত। তাদের দেশ থেকে যারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফিরিয়ে নেবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওরা বলছে যে সে দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এ নিয়ে তাদের কাছে কোন না কোন প্রমাণ রয়েছে। নাগরিকত্বের সনদ তো আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছে। সঙ্গতকারণে নাগরিকত্ব প্রমাণের দোহাই তোলা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারাবিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা নানা অনুসন্ধান চালিয়ে যে কথা বলছে সেটাই প্রকৃত তথ্য। জাতিসংঘের পক্ষে এ নিয়ে রিপোর্টও দেয়া হয়েছে। এরপরেও মিয়ানমারের গোয়ার্তুমিতে ভাটা নেই। ১৯৭৮ সালের পরে আরও কয়েক দফায় রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ আগস্ট মধ্যরাতের পর সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আসে আরও ৭ লক্ষাধিক। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা এখন ১২ লক্ষাধিক। যার মধ্যে সরকারী নিবন্ধনের আওতায় এসেছে ১১ লক্ষাধিক। এছাড়া নিবন্ধনের বাইরেও রয়েছে বহু। ’৯২ সালে পালিয়ে আসা ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তখন ১৯ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয় সরকার। পরবর্তীতে প্রত্যাবাসন শুরু হলে আড়াই লাখ নিজ দেশে ফিরে যায়। এ প্রক্রিয়ায় মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। ওই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের পাঠানো ছাড়পত্র অনুযায়ী ৯ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত যেতে পারেনি। ওসব রোহিঙ্গা কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া-লেদা এলাকায় বস্তি তৈরি করে বসবাস শুরু করে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও ৩০ ক্যাম্প। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষ এতে কোন ভ্রুক্ষেপ করছে না। বিশ্বব্যাপী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। নিন্দার পর নিন্দার ঝড় উঠেছে। কিন্তু মিয়ানমারকে কোনভাবে টলানো যাচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার একেক সময় একেক ধরনের শর্ত আরোপ করছে। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে কখনও ভাল ছিল না। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এরা টিকে আছে আশ্রিত হিসেবে। এছাড়া ভিনদেশের এসব লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ সময় আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের পক্ষে সম্ভব নয়, সরকার পক্ষে ইতোমধ্যে জানান দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমাধান কোথায় তা নিয়ে সরকার বিশ্বের বিভিন্ন স্তরে নানা প্রস্তাব ইতোমধ্যে দিয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বহু দেশ এসব প্রস্তাবকে সমর্থনও দিয়েছে। কিন্তু সামরিক জান্তা প্রভাবিত মিয়ানমারের কথিত গণতান্ত্রিক সরকার সেনা প্রণীত বাণিজ্যিক স্বার্থের নীলনক্সার বাইরে যাওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না তা প্রতীয়মান। সর্বশেষ গতবছরের ২৫ আগস্টের দু’মাস পর প্রত্যাবাসন নিয়ে যে চুক্তি করেছে সেটারও লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। অর্থাৎ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলে তা থেকে বিরত রয়েছে। সাম্প্রতিক মানব জাতির ইতিহাসে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে জঘন্যতম ঘটনার সঙ্গে জড়িত সেনানায়কদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি ওঠার পর এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বটে কিন্তু তা নিয়েও মিয়ানমার পক্ষ নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে। সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্লেষক মহলে এ ইস্যুর ভবিষ্যত কি- তা নিয়ে নানা শঙ্কা জন্ম নিয়েছে। তবে জাতিসংঘের উদ্যোগে ইউএনএইচসিআর সহযোগিতায় সীমান্তের ওপারে এপারে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচী শুধুমাত্র তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার পক্ষ যে মনোভাবে রয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, এ ইস্যুর সমাধান এখনও সুদূরপরাহত।
×