ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামেও বরাদ্দ

৫২ জিআর প্রকল্পে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 ৫২ জিআর প্রকল্পে অনিয়ম

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও, ৭ সেপ্টেম্বর ॥ জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মন্দিরের নামে বরাদ্দকৃত জেনারেল রিলিফ (জিআর) ৫২টি প্রকল্পের ২১ মে. চাল হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে সরকারী দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তার যোগসাজশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও তাদের সহযোগীরা ভুয়া প্রকল্প জমা দিয়ে এসব চাল ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সরকারী বরাদ্দের চাল আত্মসাতের অভিযোগে গত ৩০ আগস্ট সদর উপজেলার ঢোলরহাট এলাকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লোকজন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। সরেজমিনে সদর উপজেলার আখানগর, রুহিয়া পশ্চিম, ঢোলরহাট, রাজাগাঁও ইউনিয়নের ৫২টি প্রকল্প যাচাই করে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানায়, জিআর প্রকল্পের মাধ্যমে গত জুন মাসে সদর উপজেলার মসজিদে ওয়াজ মাহফিল, মন্দিরে নামযজ্ঞ ও মাদ্রাসা এতিমখানায় খাবারের জন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২১৭ টন খাদ্যশস্য (চাল) বরাদ্দ দেয়া হয়। সদর উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির মোঃ শামসুজ্জামান ওরফে দুলাল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিজস্ব লোকজনকে প্রকল্প সভাপতি দেখিয়ে বরাদ্দের চাল হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কাজে ইউএনও ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সহায়তা করেছেন বলে জানা যায়। সদর উপজেলার ঢোলরহাট ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের সরকারপাড়া জামে মসজিদের জন্য গত অর্থবছরে জেনারেল রিলিফ (জিআর) প্রকল্পে এক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। মসজিদ কমিটির সভাপতি সামসুল আলম ছিলেন ওই প্রকল্পের সভাপতি। তিনি কেবল নথিপত্রে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। সরকারী দলের ‘ঘনিষ্ঠ’ সাবেক জামায়াত নেতা দুলাল সেই চাল উত্তোলন করে তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ওই মসজিদের ইসলামী জলসার জন্য আরও এক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পের কথা জানতেন না সামসুল আলম। কিন্তু তার সই জাল করে ওই চাল তুলে নেয়া হয়েছে। তালিকায় মাধবপুর ফোরকানিয়া মাদ্রসায় ইসলামী জলসা জন্য এক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে সদর উপজেলায় জেনারেল রিলিফ (জিআর) প্রকল্পে এতিমখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য সরকারী বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। অনেক স্থানে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে চাল তুলে নেয়া হয়েছে। জানাজানি হওয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র কিছু টাকা দেয়া হয়েছে। মাধবপুর গ্রামের একই চত্বরের ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার উচ্চবিদ্যালয়, মাহালিয়াহাট শ্র্র্রী শ্রী কালী মন্দিরে মহানামযজ্ঞ অনুষ্ঠান, মাহালিয়াহাট জামে মসজিদ মাঠে ইসলামী জলসার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নামে এক মেট্রিক টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জব্বার বলেন, আমি প্রকল্প সভাপতি এটা সত্যি। তবে বরাদ্দের চাল আমি তুলতে যাইনি। বরাদ্দ নেয়ার সব প্রক্রিয়া দুলালই (শামসুজ্জামান) করেছে। আমি শুধু সই করেছি। গত কয়েকদিন আগে তিনি আমার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেন। আর এ মাঠে তো কোন ইসলামী জলসা হয়নি। জলসার নামে কে চাল তুলেছে, তা বলতেও পারব না। পাটিয়াডাঙ্গী এতিমখানা, লিল্লাহবোর্ডিং ও হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ওয়াজ মাহফিল ও আসাননগর কাদেরিয়া দাখিল মাদ্রাসা এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ছাত্রদের খাওয়ার জন্য এক টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্প দুটির সভাপতি হলেন ইউসুফ আলী ও দুলাল হোসেন। বরাদ্দ দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠান এক ছটাক চাল পাননি। তবে স্থানীয়রা জানান, ইউসুফ ও দুলাল নামের ওই দুই ব্যক্তিকে কেউ চিনেন না। রুহিয়া ক্যাথেলিক মিশন শিশু সদনের নামে দুই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে কিছুই জানে না। প্রকল্প সভাপতি হিসেবে রুহিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য গ্যাবরিয়াল দাসের নাম থাকলেও তিনি জানান, তার সই জাল করে বরাদ্দ উত্তোলন করা হয়েছে। ঢোলরহাট ইউনিয়নে রুহিয়া সড়কের পাশে ঢোলরহাট হাইস্কুল জামে মসজিদ ও ঢোলরহাট জামে মসজিদে ওয়াজ মাহফিলের জন্য বরাদ্দ নেয়া হয়েছে দুই মেট্রিক টন চাল। কিন্তু ওয়াজ মাহফিল দেখানো হলেও মসজিদ দুটি একই। হোসেন আলী নামে এক এলাকাবাসী বলেন, ঢোলরহাট এলাকায় ঢোলরহাট জামে মসজিদ নামে কোন মসজিদই নেই। আর সেখানে ওয়াজ হবে কেমন করে। ওয়াজ মহফিলের জন্য এক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পায় ঢোলরহাট হাইস্কুল জামে মসজিদ। এই প্রকল্প সভাপতি হলেন মসজিদ কমিটির সভপতি আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান আমাকে কাগজপত্রে সই করতে বলেছেন আমি দিয়ে দিয়েছি। কে চাল তুলেছে, চাল কোথায় গিয়েছে বলতে পারব না। ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের সরকারপাড়া জামে মসজিদের জন্য এক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্প সভাপতি হলেন মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজী মোঃ সামসুল আলম। তাকে আরেকটি প্রকল্প সভাপতি দেখিয়ে একই মসজিদ মাঠে ইসলামী জলসার নামে আরেক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ নেয়া হয়। কিন্তু ওই মসজিদে গিয়ে জানা গেছে, নিজে প্রকল্প সভাপতি হলেও হাজী সামসুল মাধবপুরের বাসিন্দা জামায়াতের সদর উপজেলার সাবেক আমির মোঃ শামসুজ্জামান ওরফে দুলাল তাকে মসজিদের জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামী জলসার প্রকল্পেও সভাপতি হলেও তাকে বিষয়টি জানানো হয়নি। এ বিষয়ে তিনি জানান, ইসলামী জলসার প্রকল্পে তার যে সই দেয়া আছে, তা জাল। তিনি শুধু একটি প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে কাগজপত্রে সই করেছেন। তালিকায় মাধবপুর ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ইসলামী জলসা জন্য এক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মাধবপুর গ্রামের একই চত্বরের ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার উচ্চবিদ্যালয়, মাহালিয়াহাট শ্রী শ্রী কালী মন্দিরে মহানামযজ্ঞ অনুষ্ঠান, মাহালিয়াহাট জামে মসজিদ মাঠে ইসলামী জলসার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নামে এক মেট্রিক টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জব্বার বলেন, আমি প্রকল্প সভাপতি এটা সত্যি। তবে বরাদ্দের চাল আমি তুলতে যাইনি। বরাদ্দ নেয়ার সব প্রক্রিয়া দুলালই (শামসুজ্জামান) করেছে। আমি শুধু সই করেছি। গত কয়েকদিন আগে তিনি আমার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেন। আর এ মাঠে তো কোন ইসলামী জলসা হয়নি। জলসার নামে কে চাল তুলেছে, তা বলতেও পারব না। পিআইও গোলাম কিবরিয়া ছোট বালিয়া মসজিদের নামেরে প্রকল্পটির সভাপতির নাম ছাড়া আর কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরে জমা দেয়ার কথা বলে মোশারুল সাহেব (মোশারুল ইসলাম সরকার) এই নামটা দিয়েছেন। মোশারুল ইসলাম সরকার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজাগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখা, জেআরসহ সরকারী সহায়তা ও কর্মসূচী নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এই কথা শুনে ফরহাদ আহাম্মেদ চৌধুরী ও তার সঙ্গীদের রোষানলে পরেন পিআইও। পরে সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আশরাফুল হক চৌধুরীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ওয়াজ মহফিলের জন্য এক মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পায় ঢোলরহাট হাইস্কুল জামে মসজিদ। এই প্রকল্প সভাপতি হলেন মসজিদ কমিটির সভপতি আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান সীমান্ত কুমার বর্মন আমাকে কাগজপত্রে সই করতে বলেছেন আমি দিয়ে দিয়েছি। এরপর আর কিছু জানি না। ঝলঝলিপুকুর জামে মসজিদের সভাপতি ও ওয়াজ মাহফিলের প্রকল্প সভাপতি মোঃ শাহ আলম বলেন, আমি মসজিদ কমিটির সভাপতি। মসজিদের আয়োজনে কখনও ওয়াজ মাহফিল করলাম না। কিন্তু আমাকে প্রকল্পের সভাপতি করে, আমার সই জাল করে সরকারী বরাদ্দের চাল উত্তোলন করা হলো। আর সেই চাল বিক্রির টাকা চলে গেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সীমান্ত কুমার হাতে, এটা কেমন কথা। এখন ঘটনা ফাঁস হওয়ায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চাল বিক্রির সামান্য টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এছাড়াও ঢোলরহাট ইউনিয়নের মাধবপুর জোতপাড়া দুর্গা মন্দির, গোল্লাল বাবু দুর্গা মন্দির, মাহালিয়াহাট শ্রী শ্রী কালী মন্দির, বড়বাড়ি ধর্মপুর দুর্গা মন্দির ঝলঝলিপুকুর জামে মসজিদ, হঠাৎপাড়া জামে মসজিদ, মাধবপুর পশরতেলী জামে মসজিদ, পশরতেলী ঈদগাহ মাঠ, মাহালিয়াহাট জামে মসজিদ, উত্তর বোয়ালিয়া (রাস্তার পশ্চিম) জামে মসজিদ, সন্ন্যাসীপাড়া জামে মসজিদ, হারাগাছপাড়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, কলাবাগান জামে মসজিদ ও রুহিয়া ইউনিয়নের ম-লাদাম সরকারপাড়া জামে মসজিদে ওয়াজ মাহফিল, সেনিহারি তালতলী দুর্গা মন্দির, সেনিহারি তালতলি হরিমন্দিরের নামে চাল বরাদ্দ নামে বরাদ্দ দেয়া চাল আত্মসাত করা হয়েছে। কার্তিকতলা হরিমন্দিরের বরাদ্দ দেয়া চালের বিপরীতে ১০ হাজার টাকা রুহিয়া পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অনিল কুমার সেনের হাত থেকে পেয়েছেন বলে হরিমন্দিরের সভাপতি নগেন বর্মণ জানিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে শামসুজ্জোহা ওরফে দুলাল জানান, আমি এলাকায় সামাজিক কাজ করি। সরকারী বরাদ্দ কিভাবে পেতে হয়, অনেকেই জানেন না। সেসব বরাদ্দ উত্তোলনে আমি তাদের সহায়তা করি। ঢোলার হাট ইউপি চেয়ারম্যান নির্মল কুমার বর্মন জানান, এলাকার সরকারী কিছু বরাদ্দের চাল আত্মসাত করা হয়েছে এটা সত্যি। তবু নিজের দায়িত্ব থেকে মসজিদ-মন্দিরে কিছু কিছু টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করছি। সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) গোলাম কিবরিয়া জানান, বরাদ্দের চাল জুনের একেবারে শেষ দিকে এসেছিল। এ কারণে বরাদ্দের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
×