ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুপির জায়গায় বিজলি, কাঠ কয়লায় এলপিজি

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

   কুপির জায়গায়  বিজলি, কাঠ কয়লায় এলপিজি

রশিদ মামুন ॥ টাঙ্গাইলের মালতিপাড়া, বছর চারেক হয় এই গ্রামে বিজলির আলো জ্বলেছে। এরপর থেকে ঘরের কেরোসিনের বাতিকে একরকম বিদায় বলেছে পেশায় ভিক্ষুক কমলা বেগমও। কিন্তু বিদ্যুত কি আর সব সময় থাকে? তখন কি উপায়! এখন বাজারে কম বিদ্যুত খরচে জ্বলবার মতো লাইট-ইমিটিং ডায়োড বা এলএইডি বাতি পাওয়া যায়। কেরোসিনের বদলে এই বাতির খরচও কম। সঙ্গত কারণে বিদ্যুত না থাকলেও বিদ্যুতের আলোই আঁধার ঘুচায় কমলা বেগমের। আবার নড়াইলের নওয়াগ্রামের শাহিনা আহমেদ পেশায় গৃহিণী। বছর কয়েক আগেও রান্নার জন্য প্রধান্য পেত কাঠ। বাজার থেকে শুকনা বা ভেজা কাঠ কিনে এবং বাড়ির গাছপালা থেকে কাঠে রান্নার জ্বালানির সংস্থান করতেন। এখন রান্না ঘরের জ্বালানি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি। কেন কাঠের বদলে এলপিজি এমন প্রশ্নে তিনি জানালেন, মূল বিষয় হচ্ছে প্রাপ্যতা। এখন গ্রামের বাজারেই এলপিজি সিলিন্ডার পাওয়া যায়। ফোন করে বললেই এলপিজি দিয়ে যাচ্ছে। কাঠ কয়লার মতো কালি নেই। ব্যবহার সহজ। ধোয়া নেই। পরিবেশ দূষণ নেই। সুবিধাজনক এই ব্যবহারের কারণে গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে এলপিজি ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। টাঙ্গাইলের মালতিপাড়া থেকে নড়াইলের নওয়াগ্রাম এই হচ্ছে জ্বালানি আর বিদ্যুত ব্যবহারে বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার গল্প। গত ১০ বছরে ধীরে ধীরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন এখন দৃশ্যমাণ হয়ে উঠেছে। মাত্র ১০ বছরের বদলকে কেউ যদি মিলিয়ে দেখেন তাহলেই এই সাফল্যকে অভাবনীয় বলবেন। জনগণের জীবন মান উন্নয়নে বিস্তর প্রভাব রেখে চলেছে বিদ্যুত এবং জ্বালানি খাত। চার বছর আগের ঘটনা। মালতি পাড়ায় বিদ্যুত সরবরাহের আয়োজন করছিল টাঙ্গাইল পল্লী বিদ্যুত সমিতি। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে শ্রমিকদের আপ্যায়ন করছিল। এর মধ্যে চেয়েচিন্তে জীবন চালানো কমলা বেগম কয়েক দিন চাল নিয়ে গেছেন। গ্রামে বিদ্যুত এলে সেই আলোর সুবিধা যখন তিনিও ভোগ করবে। অনেকটা জোর করেই অংশ নিয়েছেন। ঘরে বিদ্যুত নেই এমন মানুষের বিদ্যুত পাওয়ার আকাক্সক্ষা অনেকটা কমলা বেগমের মতোই। সরকার বলছে দেশের সব মানুষকে আগামী বছরের মধ্যে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনা হবে। এজন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। মানুষ দ্রুত বিদ্যুত পেতে দালাল ধরছে। আরইবির এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ঘুষও নিচ্ছে। আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব. মঈন উদ্দিন বলছেন, গত বছরই আরইবি ৩৯ লাখ মানুষকে বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। দালালদের সহাতায় ঘুষ নিচ্ছে কেউ কেউ তাদের শাস্তিরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চার জন জেনারেল ম্যানেজার আর ডজনখানেক এজিএমকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এভাবে দালালদের হাতে কেউ টাকা না দিলেও তিনি বিদ্যুত পাবেন। সুতরাং কারও টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী অবশ্য বলছেন চলতি বছরের মধ্যে সব ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে যাবে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের কাছে ইতোমধ্যে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছে সরকার। দেশের ৪৬০টি উপজেলার মধ্যে এই পর্যন্ত ৭৯টি উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও ১৬০টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া ৮০টি উপজেলা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসবে। এ হিসেবে ডিসেম্বর নাগাদ ৩১৯টি উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা যাচ্ছে। বাকি থাকবে আরও ১৪১টি উপজেলা। যেখানে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করতে সময় লাগবে বড়জোর ছয় মাস। অর্থাৎ আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে কেরোসিনের বাতিকে বাংলাদেশ বিদায় বলতে পারবে। যদিও ঘরে বিদ্যুত থাকলেও ২৪ ঘণ্টা জুড়েই বিদ্যুত থাকা না থাকা নিয়ে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। তবে সরকার বলছে বিদ্যুত একবার ঘরে পৌঁছে গেলে পরিস্থিতি উন্নয়নে পরেও কাজ করা যায়। সারাদেশের মানুষের কাছে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার মতো বিতরণ এবং সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার সেই কাজটি গুরুত্বসহকারে করছে। জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ পেতে এখনও সময় লাগবে। বিদ্যুত বিভাগ বলছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্প এলে সামগ্রিকভাবে বিদ্যুত ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। স্থায়িভাবে অনেক সঙ্কটের সমাধান হবে। সঙ্গত কারণে এখনই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের ঘোষণা বাস্তবসম্মত নয়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে দেশে এলপিজি মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। এখন সেই উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ গুণ বেড়ে হয়েছে সাত লাখ মেট্রিক টন। এই দুই সময়ের পার্থক্য যদি করা হয় তাহলে দেখা যাবে ২০০৯ সালে এলপিজির মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ মেট্রিক টন এখন যা ৩৫ লাখ ৫০ হাজার বেড়ে হয়েছে ৩৮ লাখ। ক্রমেই এই ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। বলাবাহুল্য সরকার এলপিজিতে গ্রাহকের স্বস্তি দিতে চাইলেও জ্বালানি বিভাগ এবং পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন গত ১০ বছরে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সরকারী খাতে নতুন এলপিজি প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে এক প্রকার অনীহা দেখিয়েছে বিপিসি। যদিও বেসরকারী খাত এখানে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। সারাদেশে ১৮ প্ল্যান্ট এলপিজি উৎপাদন করছে। আর ৫৮টি প্রাথমিক অনুমোদন নিয়েছে। এরমধ্যে প্রায়সবগুলোই বেসরকারী উদ্যোক্তাদের। দেশের দক্ষিণপশ্চিম এবং উত্তরের জেলাগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ নেই। অপরদিকে দেশের মধ্য দক্ষিণ এবং পূর্বের জেলাগুলোতে গ্যাস রয়েছে। যদিও এসব এলাকার একেবারে তৃণমূলে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়নি। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে পরিবহনেও এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুমুখী ব্যবহার বাড়লে এলপিজির ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসবে। এতে গৃহিণীদের স্বস্তি মিলবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকারের উচিত এলপিজির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এককভাবে ব্যবসায়ীদের সুযোগ না দিয়ে ভোক্তাদের কথাও ভাবা উচিত। আমাদের এখানে এলপিজির দর বেশি। এই দর সরকার উদ্যোগ নিলেই কমিয়ে আনতে পারে।
×