ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঁচ নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঁচ নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দুর্ঘটনা হ্রাস, সুষ্ঠু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঁচ দফা নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও আন্তঃজেলা রুটের চালক এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এর প্রমাণ মিলেছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছেন তারা। আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে রাজধানীতে ‘বাস বে’ নির্মাণের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, দূরপাল্লার বাণিজ্যিক বাসে সিটবেল্ট বাঁধার কোন ব্যবস্থা নেই। চালকরা বলছেন, পুলিশের নির্ধারিত বাস স্টপেজের খবর তারা জানেন না। তাই আগের নিয়মে যাত্রী ওঠানামা চলছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীতে ১২১টি বাস স্টপেজ নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ নির্দেশনার মধ্যে তিনটিই কার্যকর করা অনিশ্চিত। তবে মহাসড়কে তিন চাকার নিষিদ্ধ যানবাহন বন্ধে পুলিশ প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মালিক সমিতির নেতারা। এদিকে চালক ও যাত্রীসহ পথচারীদের নিরাপত্তায় ১৬ দফা নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটি (বিআরটিএ)। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, সুষ্ঠু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাঁচ দফা নির্দেশনা বিআরটিএর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছে। নির্দেশনাসমূহের মধ্যে রয়েছে, চলমান অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা, স্টপেজ ছাড়া গাড়ি না থামানো, পরিবহনের দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম মোবাইল নম্বর প্রদর্শন এবং দূরপাল্লার বাসে চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে বলে জানান বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী। মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যত্রতত্র বাস থামানোর চিত্র। এমনও দেখা গেছে, এক কিলোমিটার রাস্তায় অন্তত পাঁচবার বাস থামানো দৃশ্য। বেশিরভাগ বাস দরজা খোলা রেখেই চলাচল করতে দেখা গেছে। অন্তত ১০০টি বাস ঘুরে একটিতেও চালক-সহকারীর ছবি-নাম ও মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের নজির মেলেনি। দূরপাল্লার বাসে চালকসহ যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহার একভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে কি ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সুষ্ঠু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, একদিনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সকল পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে নির্দেশনা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করারও কথা জানান তিনি। উল্লেখ্য, রাজধানীর ১১ লাখের বেশি যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য মাত্র ১১জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা মালিক শ্রমিকদের আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছি। ঢাকায় চারটি ভিজিলেন্স টিম কাজ করছে। সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা এখন সোচ্চার। কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। তবে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে একটু সময়ের প্রয়োজন। আন্তঃজেলা বাসে চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুব লাক্সারিয়াস বাস ছাড়া সিটবেল্ট বাঁধার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই এই সিদ্ধান্ত শতভাগ কার্যকর করা কঠিন। কারণ দূরপাল্লার বেশিরভাগ বাসই সাধারণ। মালিক সমিতি এ বিষয়ে কথা বলে মন্ত্রণালয়কে জানাবে। ট্রাফিক সচেতনতার মাস উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রাজধানীতে ১২১টি বাস স্টপেজ করার কথা জানানো হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে ‘বাস স্টপেজ’ লেখা এরকম সাইনবোর্ড আছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দায় সেরেছে পুলিশ। এ বিষয়ে পরিবহন চালকদের সচেতন করা হয়নি। আর বাস চালকদের ইচ্ছেমত থামানো ও যাত্রী ওঠানো যুগের পর যুগের অভ্যাস। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাঁচ দফা সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মতিঝিল থেকে গাজীপুরগামী ‘গাজীপুর পরিবহন’ ও গুলিস্তান থেকে মাওনাগামী ‘প্রভাতী বনশ্রী’ পরিবহনের কিছু বাস দরজা বন্ধ করে চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে ইচ্ছেমত যাত্রী ওঠানামার অভ্যাস রয়েই গেছে। লাব্বাইক, তুরাগ, অনাবিল, ছালছাবিল, রাইদা, নূর-এ মক্কা, নিউ ভিশন, আট নম্বর, বলাকা, সিটি সার্ভিস, বিআরটিসি বাস, ছয় নম্বরসহ বেশিরভাগ বাস গেট খোলা রেখে চলতে দেখা গেছে। লাব্বাইক পরিবহনের চালক আজিম জানান, কোথায় বাস থামাতে হবে এরকম কোন নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। আমরা জানিও না কোথায় যাত্রী-ওঠানামা করাতে হবে। একই কথা বললেন তুরাগ পরিবহনের চালক আলাল মিয়া। তিনি বলেন, আমাদের যেভাবে বলবে আমরা সেভাবেই গাড়ি চালাতে রাজি। বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির থেকে লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাস যাত্রী তুলে ১০০ গজ সামনে আবারও দাঁড়ায়। সেখান থেকে বাসাবো মোড়, ফ্লাইওভার পার হয়ে আরও অন্তত তিনবার দাঁড়িয়েছে বাসটি। অথচ যাত্রীদের কাছ থেকে সিটিং সার্ভিসের নামে কোম্পানিটি নিচ্ছে বাড়তি ভাড়া। ভেতরে দাঁড়ানো অবস্থায় যাত্রী পরিবহন করার চিত্র দেখা গেছে। একই অবস্থা রাইদা ও ছালছাবিল পরিবহনেও। এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত তিন থেকে পাঁচবার থেমেছে এসব কোম্পানির বাস। জামালপুর থেকে আসা যাত্রী মিনহাজ জানালেন, আসার পথে সিটবেল্ট ব্যবহার করিনি। এরকম ব্যবস্থা বাসে চোখে পড়েনি। নেত্রকোনা থেকে আসা যাত্রী আসাদ জানান, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করানো বাস চালকদের পুরনো অভ্যাস। সিটবেল্টের বালাই নেই বাসে। দরজা খোলা রেখেই গাড়ি ঢাকায় আসার কথা জানান এই যাত্রী। জানতে চাইলে, মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জানান, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা মেনে কাজ শুরু করেছি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ইতোমধ্যে চালকদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, হাইওয়েতে তিন চাকার নিষিদ্ধ বাহন চলাচল বন্ধ হোক আমরাও চাই। কোথায় কোথায় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না আমরা খোঁজ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছি। নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করায় টঙ্গী-গাজীপুর পর্যন্ত এখন সড়ক ফাঁকা। রাস্তা খারাপ থাকলেও দ্রুত সময়ে যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন। রাজধানীতে নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থামাতে হলে সরকারের কাছে ‘বাস বে’ করে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বাস বে না থাকলে যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা খুবই কঠিন। প্রাইভেট গাড়ির যাত্রী ও চালকের জন্য সিটবেল্ট বাঁধার বিধান প্রযোজ্য দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক বাসে সিটবেল্ট বাঁধা যায় এটা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া এরকম কোন পদ্ধতি আছে বলে আমরা জানিনা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। সকলে মিলে চেষ্টা করলে সড়ক নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হবে বলেও আশাবাদী এই পরিবহন নেতা। বিআরটিএ’র ১৬ নির্দেশনা ॥ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৬টি নির্দেশনা জারি করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, ফুটপাথ দিয়ে ও রাস্তায় বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল না চালানো, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহার, বৈধ এবং হালনাগাদ কাগজপত্র ছাড়া মোটরসাইকেল না চালানো, যেখানে সেখানে মোটরসাইকেল পার্কিং না করা, যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন মোটরযান রাস্তায় না নামানো, ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এলাকা-রাস্তার বাঁক ও সরু ব্রিজে ওভারটেকিং না করা, গাড়ি চালানোর সময় ইয়ার ফোন ও মোবাইলে কথা না বলা, একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো-গতিসীমা লঙ্ঘন করে গাড়ি না চালানো, ট্রাফিক আইন-ট্রাফিক সাইন-ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশ মেনে চলা-সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো, উল্টোপথে গাড়ি না চালানো, পথচারীদের ফুটপাথ ব্যবহার করা, যেখানে ফুটপাথ নেই সেখানে রাস্তার ডানপাশ ধরে সাবধানে চলাচল করা, জেব্রা ক্রসিং-ফুট ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পারাপার, দৌড়ে অথবা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার না হওয়া, লেন মেনে গাড়ি চালানো, মহাসড়কে ইজিবাইক-নসিমন-করিমন-ভটভটি ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন/রিক্সা না চালানো। গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর হোটেল রেডিসনের বিপরীত পাশের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের ঢালের সামনের রাস্তার ওপর জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ওপর উঠে পড়ে। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত ও ৯ জন আহত হয়। নিহত দুই শিক্ষার্থী হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম ওরফে রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬)। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। প্রায় এক সপ্তাহ অচল হয়ে যায় গোটা রাজধানী। এরপর সরকারের দেয়া আশ্বাসে ঘরে ফিরে শিক্ষার্থীরা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও নেয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। এরমধ্যে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে রাজধানীতে চুক্তিতে আর বাস চালাতে দেয়া হবে না। চুক্তিতে বাস চালানো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে। এছাড়াও চালক ও গাড়ির বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কোন বাস রাজধানীতে চলতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দূরপাল্লার বাসও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া চলতে না দেয়ার ঘোষণা দেন মালিক-শ্রমিকরা। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চারটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়। এই টিম নগরীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালসহ সড়কে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
×