ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

তাজমহল কি মৃত্যুর মুখে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

তাজমহল কি মৃত্যুর মুখে

তাজমহল! যুগ যুগ ধরে এই সমাধিসৌধটি প্রয়াত সম্রাজ্ঞীর প্রতি এক সম্রাটের অমর প্রেমের মহাকাব্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট শাহজাহানের এই অপরূপ সৃষ্টির মধ্যে শুধু যে প্রেমের ফ্যান্টাসি মিশে আছে তা নয়, এটি হচ্ছে মুঘল আমলের গৌরব গাথা, স্থাপত্য শিল্পের চমৎকারিত্ব ও অসাধারণত্বের এক আশ্চর্য সমাহার। ভারত বিশ্বের একমাত্র যে বিস্ময়টির অধিকারী তা হলো এই তাজমহল। কিন্তু সেই স্থাপত্য শৈলীর বিস্ময়কর নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক এই সৌধ আজ আধুনিকতার অভিশাপে অস্তিত্বের এক ভয়ঙ্কর তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত। তাজমহল এখন মহাসঙ্কটে। পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণে হুমকির মুখে এই সৌধ। ইতোমধ্যে এর সেই শুভ্র-সুন্দর রূপের আগের চেহারাটি আর নেই। শ্বেত মর্মরের রং বদলে গিয়ে সে জায়গায় লেগেছে সবুজ ও হলদে ছোপ। যে যমুনার জলরাশিতে তাজমহলের অপরূপ প্রতিবিম্ব দেখা যেত তার পানি দিন দিন এমনভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে যে, তার ফলে তাজমহলের ভিতও দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় এই সমাধিসৌধটি মাটিতে দেবেও যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে তাজমহলের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কারণ মূলত পরিবেশ দূষণ। এই দূষণও বহুমাত্রিক। কোনটি কোনটির চেয়ে কম তো নয় বরং অধিকতর ভয়ঙ্কর। ১২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যমুনা নদী আগ্রায় এসেছে। এই আগ্রায় মোট ৯০টি নর্দমার বর্জ্য এসে পড়ে যমুনায়। পানি বিদ্যুত প্রকল্প, খনিজ সম্পদ আহরণ, শিল্পের বর্জ্য, বন কেটে উজাড়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং যমুনার বন্যা বিধৌত ভূমি দখলের ফলে আগ্রায় এই নদীটি পরিবেশগতভাবে একটি মৃত নদী। তার ওপর লাগামহীন বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশে সৃষ্টি হচ্ছে গভীর খাদ ও গর্ত। মর্মর পাথর ক্ষয়ের একটা বড় কারণ রাজস্থান থেকে এবং নদীর শুকিয়ে যাওয়া অংশ থেকে বালু মেশানো বাতাস এসে আছড়ে পড়ে। অনেক সময় ধূলিঝড়ও আঘাত হানে তাজমহলের ওপর। কখনও কখনও ঝড়ের গতি হয় ঘণ্টায় এক শ’ কিলোমিটার। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুমন্ডলের কার্বন তাজমহলের ভয়ানক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এর মার্বেলের শ্বেত বর্ণ বদলে গিয়ে সবুজাভ ও হলদেটে রং ধারণ করেছে। বলা বাহুল্য, আগ্রা হলো বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক দূষিত নগরী। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সম্ভবত নদী হিসেবে যমুনার প্রায় মৃতুবরণের কারণে। যমুনার বিশুদ্ধ নীল জলরাশির উৎপত্তি উত্তর খন্ডে হিমালয়ের যমুনোত্রি হিমবাহ থেকে। কিন্তু দুটো খাল দিয়ে যমুনার এই জলরাশি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কারণে যমুনা তার ৯৯ শতাংশ প্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। হরিয়ানায় নদীটি ক্ষীণ জলধারায় পর্যবসিত হয়েছে। এই স্থান থেকে অসংখ্য নর্দমার বর্জ্য এসে মিশে নদীর পানি পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে। পানিজল ও আগ্রার মধ্যে এই নদীর পানি কালো ও দুর্গন্ধময়। ঘরবাড়ি, পৌর ও শিল্প বর্জ্য মিশে এই অবস্থা হয়েছে। আগ্রায় আর এটি নদী নেই। একে চওড়া নর্দমা বলাই ভাল। প্রতিদিন ৬৩০ এমএলডি পৌর বর্জ্য, আবর্জনা, জীবজন্তুর মৃতদেহ, শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য এসে মিশছে। তাজমহলের পেছনে যমুনার পানি ধূসর কালো। পচা ডিমের যেমন দুর্গন্ধ তেমনি দুর্গন্ধ সেখানে। রাতের বেলা এই পানি থেকে নানা ধরনের কীট উঠে এসে সৌধে ঝাঁক বেঁধে থাকে। ওদের শরীরের স্পর্শে রাসায়নিক ক্রিয়ায় তাদের সাদা মার্বেল পাথর সবুজাভ বর্ণ ধারণ করছে। এ তো গেল যমুনা নদীর কথা। পরিবেশ দূষণের আরও কারণ আছে। আগ্রা শহর যেন আস্ত ভাগাড়। প্রতিদিন দু’হাজার মেট্রিক টন আবর্জনা প্রকাশ্য স্থানে ফেলা হচ্ছে। ২৪ শতাংশ পৌরবর্জ্য রাস্তার পাশে পোড়ানো হয়। এতে কার্বণসহ ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে মিশে তাজমহলের গায়ে লেগে এর ক্ষতিসাধন করছে। এ ছাড়াও ডিজেলের ধোঁয়া থেকে নির্গত ক্ষুদ্রা ও ক্ষুদ্র কার্বন কণা তাজমহলের শ্বেত পাথরের গায়ে এঁটে থাকছে যা অপসারণ করা কঠিন। তাজমহলের চারপাশে ১০-১২ কিলোমিটার ব্যাসের নদীতীরে রয়েছে ৮টি ঘাট। এগুলো কাপড় ধোয়া, শবদাহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়। তাজের একদম কাছেই একটি শ্মশান আছে সেখানে কাঠ পুড়িয়ে দাহ হয়। এখান থেকে নির্গত ভস্ম ও ধোঁয়া সারাদিন বাতাসে মিশছে এবং তাজের শ্বেত মর্মরের ক্ষতি করছে। এই শ্মশান ঘাটে প্রতিদিন শ’খানেক মৃতদেহ পোড়ানো হয় এবং প্রতিটির জন্য লাগে ৩শ’ কেজি কাঠ। এ থেকে দূষণের মাত্রাটা অনুমান করা যায়। তাছাড়া আছে প্লাস্টিক পণ্য। তাজমহল দর্শনার্থী পর্যটকদের জন্য প্রচুর প্লাস্টিক বোতল লাগে। সেগুলো তৈরি করে আগ্রার লোকেরাই। প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে বোতল তৈরি করতে গেলে যে কার্বণ ও মিথেন গ্যাস তেরি হয় তাতেও তাজমহলের শ্বেতপাথর হলুদাভ হয়ে যাচ্ছে। মূলত এই বায়ু দূষণের কারণেই তাজমহলের সাদা রঙের মার্বেলে বাদামি ও হলুদ ছোপ পড়ছে। সত্তরের দশক পর্যন্ত তাজমহল ছিল মুক্তার মতো সাদা বা তুষার শুভ্র। স্বপ্ন মার্বেল দিনের আলো অনুযায়ী রং বদলাত। সকালে দেখাত গোলাপী, দুপুরে জ্বলজ্বলে সাদা, সন্ধ্যায় সোনালি কমলা এবং রাতের বেলা দুধের মতো সাদা। আর এখন হলদেটে বর্ণের। সেই সঙ্গে জায়গায় জায়গায় ধূসর, কালো, বাদামি ও সবুজ ছোপ ছোপ। দূষণের কারণে স্বচ্ছ সাধাভাব আর নেই। রঙের পরিবর্তন তেমন দৃশ্যমান নয়। তাজমহলের ডিজাইনের একটা প্রধান দিক হলো অপটিক্যাল হেঁয়ালি। দক্ষিণের প্রবেশদ্বার থেকে দেখলে গোটা তাজমহল দৃষ্টির ফ্রেমের মধ্যে এঁটে যাবে। যতই এগোনো যাবে ততই তা বড় হয়ে উঠবে। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এখন আর নেই। এ বছর দক্ষিণের গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরের দিকে কেলিংগুলো ছিল সোনায় তৈরি এবং গেটগুলো ছিল রুপার। সেগুলো চুরি হয়ে গেছে বা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোন প্রতিরূপ স্থাপন করা হয়নি। লাল বেলে পাথর ছিল উজ্বল, মসৃণ, ঝকঝকে। এখন সেগুলোতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে দাগ পড়েছে। স্ল্যাবগুলোতে ফাটল ধরেছে এবং ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাজমহলের ভেতরের শিল্পকর্মে ২৮ ধরনের মূল্যবান ও আধা মূল্যবান পাথর ছিল। মুক্তা ও হীরাও ছিল। সেগুলো তো কবেই চুরি হয়ে গেছ। দীর্ঘ সবুজ গাছপালা অবস্থায় এই তুষার শুভ্র সমাধিসৌধটি চিরহরিৎ কুঞ্জের মাঝখান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। উপরে ছিল নীল আকাশ। সেই দৃশ্য তো কবেই হারিয়ে গেছে। ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ওসব বৃক্ষরাজি ও কুঞ্জবন কেটে সাফ করে দিয়ে এই মুঘল উদ্যানকে সোজাসাপ্টা ভিক্টোরিয়ান উদ্যানে পরিণত করেছিলেন। আগে যমুনা নদী ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের উৎস। মনে হতো তাজমহল যেন যমুনার জলরাশিতে ভাসছে। সেই যমুনা এখন বর্জ্য ও আবর্জনাপূর্ণ নর্দমার মতো। সেখান থেকে উঠে আসা কীটপতঙ্গে শ্বেত মর্মর হয়ে যাচ্ছে সবুজ। তাজমহলকে এখন যমুনা থেকে দেখার মতো অবস্থা নেই। নদীতীরের বালুরাশিকে টেকসই অবস্থায় রাখার জন্য সুদৃঢ় ভিতের ওপর বসানো বিশাল বিশাল কাঠের সøাবের ওপর নির্মিত হয়েছিল তাজমহল। সাড়ি সাড়ি কলাম ও খিলান এই সৌধটিকে নদীতে হেলে পড়া থেকে রক্ষা করত। ভিতটা এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যাতে নদীর পানি চুইয়ে এসে কাঠের সøাবগুলোকে সিক্ত রাখতে পারে। শক্তি অটুট রাখার জন্য কাঠের সুবিশাল সøাবগুলোর আর্দ্রতা রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু যমুনা কার্যত মরে যাওয়ায় কাঠের আর্দ্রতা থাকছে না। ফলে সেগুলো দুর্বল হয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতিতে তাজমহলের মাটিতে দেবে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। ট্যুরিস্টদের সুবিপুল চাপ তাজমহলের বিপর্যয়ের আরেক কারণ। ছুটির দিন এবং উইক এন্ডগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার ট্যুরিস্ট তাজমহল দেখতে আসে। বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে এক অস্বাস্থ্যকর আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়। তাদের পদতলের ও হাতের স্পর্শে তাজমহলের শ্বেত মর্মর পাথরে মিশছে ঘাম, তেল ও মসলা। ওগুলো জমে জমে ক্ষয় করে ফেলছে তাজমহলকে। ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের প্রায় ২২ বছরের শ্রমের এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞে নির্মিত হয়েছিল মুঘল স্থাপত্যের এক অনন্য সাধারণ নিদর্শন এই তাজমহল। আজ সাড়ে তিনশ’রও বেশি বছর পর মানুষের অপরিণামদর্শী ক্রিয়াকলাপের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় এই সমাধিসৌধটি। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×