ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীর আঁকা ছবি যেন শরতের আকাশ

এত নীল এত সাদা এত মাখামাখি, চোখ ফেরানো দায়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৯ আগস্ট ২০১৮

এত নীল এত সাদা এত মাখামাখি, চোখ ফেরানো দায়

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকার আকাশও চুরি হয়ে গেছে। ওপরের দিকে তাকালে কংক্রিটের বহুতল ভবন। গতি বাড়ানোর উড়াল সেতু। আকাশ দেখার আর সুযোগ কই? তারপরও মঙ্গলবার বিকেলে হাইকোর্ট মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখা আকাশ ভারি অবাক করল। তাকাতেই মন কেমন যেন নেচে উঠল। উহু, কথার কথা নয়। নেচে উঠল। সত্যি। এদিন আশ্চর্য রং রূপ নিয়ে ফুটেছিল শরত। গাঢ় নীলের বুকে সাদা মেঘের আছড়েপড়া। ওড়াউড়ি। তার ঠিক নিচে নারিকেল বীথি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাচীরের ভেতরে বড় হওয়া গাছগুলো ওপরের দিকে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তেই যেন ছুঁয়ে দিয়েছে আকাশ। অদূরে বহুতল ভবন। শহুরে সভ্যতার জয়গান করা ভবনগুলো আকাশকে কিছুটা আড়াল করেছে। তবুও যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা এক কথায় অপরূপ। শিল্পীর খুব যতেœ আঁকা ছবি বলেই মনে হয়। না, একদিন নয়। এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে এমন ছবি। কারণটি আগেই বললাম, শরত চলছে। ভাদ্র আশ্বিন দুই মাস শরতকাল। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আর বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়। শরতেও নতুন করে সেজেছে প্রকৃতি। আকাশটা সহজে দেখা যায়। সবসময়ই সুন্দর আকাশ। তবে এখন যে বিউটি, প্লিজ, একবার চোখ মেলে তাকান। দেখুন। এত নীল, এত সাদা, এত মাখামাখি চমকিত না হয়ে পারবেন না। কবিগুরুর ভাষায়Ñ আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে...। এসেছে শরত। ইতোমধ্যে কয়েকদিন গত হয়েছে। নদীর ধারে দুলতে শুরু করেছে কাশফুল। শিউলী ফোটারও এখন সময়। আহ, কী ঘ্রাণ! শিউলির ঘ্রাণে ভরে উঠবে চারপাশ। ছোট বড় আরও কত পরিবর্তন শরতের হাত ধরে হয়! এবারও হচ্ছে। হবে। শরতের এই পরিবর্তন আর প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলাÑ/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাইÑ লুকোচুরি খেলা...। প্রেমের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। শরতের শিউলি প্রেমের কবিকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছিলেনÑ এসো শারদপ্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...। শরতের মিষ্টি সকালটির বর্ণনাও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়, যেখানে তিনি লিখেছেনÑ শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। শরতে শুধু প্রকৃতি নয়, মনও কেমন যেন বদলে যায়। পরিবর্তিত হয়। সেই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...। নজরুল শরতে হারানো প্রিয়াকে মিস করেছেন খুব করে। সে কথা জানিয়ে লিখেছেন, শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/ এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...। একইরকম বিরহ আক্রান্ত হয়ে কবি লিখেছেনÑ দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/ শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। প্রায় অভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে কবিগুরু লিখেছেনÑ আজি শরতাপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।/ ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। কবিতার এসব ছন্দ বলে দেয়, দারুণ আবেগের ভালবাসার ঋতুটি শরত। প্রতি বছরই বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ ঋতুকে বরণ করে নেয়া হয়। নাচ গান কবিতায় শরত বন্দনা করে বাঙালী। ঢাকার সংস্কৃতিকর্মীরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এবার ঈদের কারণে বরণ অনুষ্ঠান পিছিয়েছে। সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বাতিঘর ছায়ানট শরত উৎসবের আয়োজন করবে। একইরকম উৎসব আয়োজন করবে উদীচী। সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠীও প্রতি বছর শরত উৎসবের আয়োজন করে আসছে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় সত্যেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইটের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের ছয়টি পৃথক ঋতু রয়েছে। একেকটির একেক স্বভাব। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় প্রকৃতিও। শরতেও তাই হচ্ছে। আমরা চমৎকার এই পরিবর্তনগুলো আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে চাই। নিজ দেশের প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে তাদের অবগত করতে চাই। তারা ভেতর থেকে ফিল করবে। উপভোগ করতে শিখবে। সে লক্ষ্যেই শরত উৎসবের আয়োজন বলে জানান তিনি।
×