ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও পাঁচ জেনারেলের;###;জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন ;###;পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ হবে ১৮ সেপ্টেম্বর ;###;সুচি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছেন

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৮ আগস্ট ২০১৮

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের যেভাবে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে তা সবই ভয়াবহ গণহত্যার উদ্দেশে। এ গণহত্যার দায় কোনমতেই মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংসহ ৫ সিনিয়র জেনারেল এড়াতে পারেন না। এ দায় সম্পূর্ণরূপে তাদের। আর এ জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার হতে হবে। সোমবার জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সোমবার এই রিপোর্টের তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন থেকে চৌম্বক অংশই প্রকাশ করা হলো। রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা, নির্যাতন, অন্যান্য অঞ্চলেও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত কর্মকা- নিয়ে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ। মিশনের এই রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীগত যে বর্বরতম ঘটনা ঘটে গেছে তা অত্যন্ত পূর্বপরিকল্পিত এবং সেনা অভিযানের নেপথ্যে রয়েছে গণহত্যা। সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসে সংঘটিত এই নৃশংস-বর্বরোচিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তা ও ঘৃণ্যতম এ কাজে বেসামরিক যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ইন্ধন জুগিয়েছে তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানানো হয়েছে রিপোর্টে। পাশাপাশি এও বলা হয়েছে, সে দেশের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচিও তার সাংবিধানিক ক্ষমতায় এই সহিংসতা থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাখাইনের নৃশংসতা বন্ধ করার ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই চুপ ছিলেন। তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছেন। সোমবার এ সংক্রান্তে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পক্ষে জমাকৃত প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণহত্যার লক্ষ্য নিয়েই রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রতিবেদনে আইনের নামে ভয়ঙ্কর এহেন অপরাধ সংঘটনের জন্য সে দেশের সেনাপ্রধান এবং জ্যেষ্ঠ ৫ জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন এই প্রতিবেদনে রাখাইনের পাশাপাশি শান ও কাচিন অঞ্চলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে; যেখানে সেদেশের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংকে মূল হোতা হিসেবেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রদত্ত রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বার্তা সংস্থার পক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহে আরও বলা হয়েছে, রাখাইনে গণহত্যায় ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক কর্তৃপক্ষও নিধনযজ্ঞের এই ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে এ ঘটনায় নোবেল জয়ী নেত্রী আউং সান সুচির বেসামরিক সরকার বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উস্কে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করেছে। সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনটি কয়েক হাজার ক্ষতিগ্রস্তের সাক্ষাতকারের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক দশক ধরেই পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। জন্মের পর থেকেই কাঠামোবদ্ধ নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা। অনুরূপভাবে প্রাচীন শান প্রদেশে ঘটা নিপীড়নের মধ্যে হত্যা, জেল, নিপীড়ন, ধর্ষণ, দাসত্বের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনে ঘৃণীত অপরাধ। রাখাইনে বাড়িঘর ধ্বংস ও রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করার আলামত সুস্পষ্টভাবে মিলেছে বলে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিশন সদস্যরা মিয়ানমারে প্রবেশ করতে না পারলেও বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষাতকার, স্যাটেলাইট ছবি, ভিডিওর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘের মিশনটি রিপোর্টে সে দেশের কয়েক সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন, যারা এ হত্যাকা-ের সঙ্গে দায়ী। যার মধ্যে প্রধান হলেন খোদ সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। এতে আরও বলা হয়েছে, দেশটিতে সেনাবাহিনীকে আইনের উর্ধে ভাবা হয়। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেনাবাহিনীর ওপর খুব একটা কর্তৃত্ব খাটানোর সুযোগ নেই। প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কৌশল ধারাবাহিক ও প্রবলভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যে কারণে নিরাপত্তার হুমকি তৈরি হয়। যাকে মিয়ানমার সরকার বরাবরই ঘটনাকে সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান হিসেবে আখ্যা দিয়ে এসেছে। এদিকে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতাদের পক্ষে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা, হত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রমাণিত। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এদের বিরুদ্ধে যথাযথ কোন পদক্ষেপ বা শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। জাতিসংঘের ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পক্ষে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে এখন কিছু ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে তারা মনে করছে। অপরদিকে, জাতিসংঘের এই ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ফেসবুক কর্র্তৃপক্ষ মিয়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ছাড়াও ২০ বর্মী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করেছে। সোমবার ফেসবুক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ফেসবুকে নিষিদ্ধ করছি’ এতে জানানো হয় সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উত্তেজনা যাতে আর বৃদ্ধি না পায় এ লক্ষ্যে তাদের এই সিদ্ধান্ত। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, আমরা মিয়ানমারে ফেসবুকে অপব্যবহার রোধে কাজ করে যাচ্ছি। চলতি বছরের শুরু থেকেই মানবাধিকার বিচার করে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। অসংখ্য মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করায় এটা আমাদের বিশাল দায়িত্ব। আমরা ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উল্লেখ্য, গত বছর ২৫ আগস্ট সেদেশের নিরাপত্তা চৌকিতে আরসা’র (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশনাল আর্মি) হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের সব পথ বন্ধ করতে আরসা’র হামলার আগে থেকেই রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে সেনা অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ।
×