ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিকল্পনা তারেকের ॥ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৬ আগস্ট ২০১৮

পরিকল্পনা তারেকের ॥ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা

বিকাশ দত্ত ॥ হাওয়া ভবন থেকে আশ্বাস পাওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই হামলায় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে, জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটানো, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য প্রশাসনিক, আর্থিক, জনবল ও বিস্ফোরক দিয়ে সহায়তা দেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে হাওয়া ভবনসহ দশটি স্থানে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দেশী ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন বিশেষ করে লস্কর-ই তৈয়বা, তেহরিক-ই জিহাদী ইসলামী এবং হিযবুল মুজাহিদিন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই একত্রিত হয়ে ২১ আগস্টে এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি ঐক্যজোট প্রশাসনিক সহায়তা এবং সরকারের উঁচু পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এখানে আশ্বাসের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক সভা এবং পরিকল্পনায় তারেক রহমান, আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, তৎকালীন এনএসআই, ডিজিএফআইর ডিজি, পুলিশের আইজি ও সিআইডির এসএসপিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এদের নির্দেশেই হামলাকারীরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে নৃশংসভাবে আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপে হত্যা করে। সংঘটিত এই অপরাধ শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া মহাদেশসহ পৃথিবীর অন্য কোথাও এভাবে এরূপ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান জনকণ্ঠকে একান্ত সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন। সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, আব্দুস সালাম পিন্টুর সরকারী বাসভবন থেকে ১৫ আর্জেস গ্রেনেড ও ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এর পরই তাদের নির্দেশে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আলামত নষ্ট করা হয় আদালতের অনুমতি ছাড়াই। দুটি মামলা করা হয়। একটি হত্যা মামলা আরেকটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। দুটি মামলার তদন্তে চারদলীয় জোট প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার জন্য এক পর্যায়ে ‘জজ মিয়া নাটক’ সৃষ্টি করে। অধিকতর তদন্তের আলোকে সর্বমোট ৫২ আসামির নাম উঠে আসে। অন্যান্য মামলায় ৩ আসামির ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়। বর্তমানে ৪৯ আসামি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ২২৫ জনের সাক্ষ্য প্রদান করেছে। আসামি পক্ষ সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন ২০ জনের। অভিযোগপত্রে সাক্ষীসহ সর্বমোট সাক্ষীর সংখ্যা ৫১১। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আসামিদের সবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত অভিযোগ সন্দেহের উর্ধে থেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এবং সম্মানিত আদালতের কাছে আমরা আসামিদের আইনের বিধান অনুয়ায়ী সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেছি। এখন লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলমান আছে। আশা করছি আমাদের প্রত্যাশা অনুয়ায়ী অচিরেই দুটি মামলার রায় এবং আদেশের দিন ধার্য করতে সক্ষম হব। রাষ্ট্রপক্ষের চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তারেক রহমানসহ অন্যরা প্রশাসনিক ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়। ঘটনার দিন পনেরোটি গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে ৯ বিস্ফোরিত ও চারটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় ছিল। জেলখানায় পাওয়া একটি সেটা জব্দ তালিকায় আসেনি। অবিস্ফোরিত গ্রেনেড আলামত হিসেবে তিনটি সেটা আদালতের অনুমতি ছাড়াই ধ্বংস করা হয়েছে। ঘটনাটি ১০ জায়গা থেকে নীলনক্সার ছক করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছক বাস্তবায়িত করা হয়। আর ৯ জায়গায় ষড়যন্ত্র ও গ্রেনেড মজুদ রাখা হয়েছিল। জায়গা হলো হাওয়া ভবন, আহসানউল্লা কাজলের মেরুলের বাসা, আনন্দনগরে মুফতি হান্নানের বাসা, মোহাম্মদপুরে আলী এ্যান্ড নুর হাউজিং এস্টেটের, আসামি সুমনের বাসা, আব্দুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির সরকারী বাসা, মিরপুরের মসজিদ ই আকবর কমপ্লেক্স ও মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটে হরকত-উল জিহাদ। এ ছাড়াও মামলার আসামি আব্দুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির সরকারী বাসভবনে মিটিং করেও এ হামলার ছক কষা হয়। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ‘তথাকথিত সাম্প্রদায়িক ও সমমনা রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি নেত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট’। ‘দেশী ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন বিশেষ করে লস্কর-ই তৈয়েবা, তেহরিক-ই জিহাদী ইসলামী এবং হিযবুল মুজাহিদিন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই একত্রিত হয়ে ২১ আগস্ট এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।’ আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া মুফতি হান্নানসহ অন্য বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার প্রশিক্ষণ নিয়ে এই অপরাধ সংগঠন করেছে। চীফ প্রসিকিউটর বলেন, আর্জেস গ্রেনেড আরও কয়েক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের হযরত শাহ জালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপরে হামলা, হবিগঞ্জে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এস এম কিবরিয়া হত্যা, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে মামলার সাক্ষী ভিক্টিম সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় হামলা এই আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও গ্রেনেড হামলা হয় ভারতে মুম্বাইয়ে হোটেল তাজ এবং পার্লামেন্ট ভবনের সামনে। গ্রেনেড হামলা হয়েছে সেটি আর্জেজ গ্রেনেড কিনা তা জানা যায়নি। তবে আমাদের এখানে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছে তা আর্জেস গ্রেনেড। আর্জেস গ্রেনেড পৃথিবীর দুটি দেশ উৎপাদন করে। একটি অস্ট্রিয়া, অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি ওয়েবসাইটে এটা প্রচার করা হয়। সেখানে সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কারো কাছে বিক্রি করে না। এটা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সেনাবাহিনী ব্যবহার করে থাকে। অস্ট্রিয়া তাদের প্ল্যান্ট বিক্রি করে দিয়েছে। এখন শুধু পাকিস্তানেই উৎপাদন হয়ে থাকে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর নানা বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছিল ললাটে, সেটার অবসান ঘটে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ও রায়ের মাধ্যমে। ’৭৫-এ ১৫ আগস্টের অপরাধ ছিল সংঘটিত অপরাধ। পরবর্তী সময়ে ৩ নবেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। তার পরবর্তী ধারাবাহিকতায় ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ’৭৫-এ তারা যে অপরাধ সংঘটিত করেছিল তার ফলে তারা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে হত্যা করতে পারেনি, বিদেশে অবস্থানের কারণে। একই পরাজিত শক্তি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে স্থানীয় বা দেশের তিনটি জঙ্গী সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো দু’তিনটি জঙ্গী সংগঠন পরস্পর যোগসাজশে চার দলীয় বিএনপি জামায়াত জোটের আর্থিক ও প্রশাসনিক সহায়তায় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার লক্ষ্যে এই অপরাধ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। প্রয়াত নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ একটি হিসেবে ২৪ অপর হিসেবে ২২ জনকে হত্যা করা হয় এবং শেখ হাসিনা ডান কানের স্মরণশক্তি হারান। শত শত নেতা কর্মী সমর্থক সাংবাদিক আইনজীবীসহ অগণিত মানুষ আহত হয়। মামলা সূত্রে জানা গেছে, ৪৯ আসামির মধ্যে ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। ৮ জন জামিনে। আর মূল চক্রান্তকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানসহ ১৮ জন এখনও পলাতক। মৃত্যুর কারণে তিন জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যে ২৫ জন কারাগারে আছেন তারা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিডিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক আব্দুর রহিম, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুস সালাম, পাকিস্তানের কাশ্মীরের জঙ্গী আব্দুল মজিদ ভাট, জঙ্গী আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম পিন্টু, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, উজ্জ্বল ওরফে রতন, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক ও বরিশালের মাওলানা আবু বকর। এ ছাড়া মামলার অন্যতম আসামি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের ইতোমধ্যেই যুদ্ধাপরাধ মামলায়, অন্য মামলায় মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ও শরিফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসিতে মৃত্যু হয়েছে। তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে মূল চক্রান্তকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানসহ ১৮ জন এখনও পলাতক। পলাতক আসামিদের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরবে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোরসালিন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে। জঙ্গী নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (পূর্ব) এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, তাদের বেশিরভাগই পাকিস্তানে রয়েছে। তবে অপর অভিযুক্ত পলাতক আসামি হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাইজউদ্দিন ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু এরা দু’জন বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। এর মধ্যে ভারতের তিহার জেলে বন্দী রয়েছে দুই ভাই হুজি জঙ্গী আনিসুল মোরসালিন ওরফে সুজয় ও মহিবুল মোত্তাকিন। পলাতক আসামিদের মধ্যে এ দু’জন সরাসরি গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিল। তারা নিজ হাতে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল সমাবেশে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে মোস্টওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পলাতকদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে রেডনোটিস জারি করা হয়েছে।
×