ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষার ক্ষণ গণনা শুরু

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৫ আগস্ট ২০১৮

 রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষার ক্ষণ গণনা শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরুর বছর পূর্ণ হলো আজ (২৫ আগস্ট)। বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত এই ঘটনার সফল সমাধানের অপেক্ষার নতুন ক্ষণগণনাও শুরু হলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে গত পুরো একটি বছরজুড়ে যা ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং মিয়ানমার সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে কখনও আনুষ্ঠানিক, কখনও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া এই রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের প্রক্রিয়াগত বিষয়টি রয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায়। রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সদস্য রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া বর্বরতার একেবারে শেষটুকুও প্রত্যক্ষ করেছে পুরো বিশ্ববাসী। অথচ এরপরও রোহিঙ্গাদের ওপর যা ঘটেছে তা স্বীকার করে না মিয়ানমার। আর এই ইস্যুতে তারা যা বলেছে এবং এখনও বলছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেকে ক্রমাগতভাবে দূরে থাকার পথই বেছে নিচ্ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এখনও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অর্থাৎ নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের যারা এখনও আছে তারা হয়ে আছে পরবাসী। আর যারা দেশান্তরি হয়েছে তারা কোথাও আশ্রিত, কোথাও শরণার্থী, কোথাও অনুপ্রবেশকারীসহ নানা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আর যারা সেনাসহ জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়ে অসময়ে মর্মান্তিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে তারা মাটির তৈরি মানুষ হিসেবে ইতোমধ্যে মাটির সঙ্গেই মিশে গেছে। অনেকের হাড়গোড়ও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রাণ হারানোদের অনেকেই গণকবরের বাসিন্দা হয়েছে শেষ ঠিকানা। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার বহুমুখী ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী তৎপরতায় কেটে গেল পুরো একটি বছর। ইতোমধ্যেই কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জন্ম নিয়েছে ৬০ সহস্রাধিক শিশু। এই হিসেব ইউএনএইচসিআর-এর। বেসরকারী হিসেবে এ সংখ্যা আরও কিছুটা বেশি। এতকিছুর পরও এখনও মাঝে মধ্যে ফাকফোঁকর দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। কিছু ঢুকে পড়তে সক্ষম হচ্ছে, আর কিছু পুশব্যাক হচ্ছে। সবমিলে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে নিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। যে কারণে খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান, ফার্স্ট লেডি, সেলিব্রেটি, বিভিন্ন পর্যায়ের তারকা, মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাসহ এমন কেউ বাদ পড়েননি যারা রোহিঙ্গাদের সরেজমিনে দেখে গেছেন, কথা বলেছেন, বাস্তব পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে গেছেন। এদের পক্ষেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর জরুরী সমাধানে নানা বক্তব্য প্রকাশের রীতিমতো হিড়িক পড়ার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, গত বছর ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যজুড়ে শুধু বেছে বেছে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হয়েছে বর্বরতম ঘটনা। যা ইতোমধ্যে গণহত্যার সামিল হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এর আগেও দফায় দফায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের লেলিয়ে দেয়া বিভিন্ন বাহিনীর আক্রোশের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এরপর গত আগস্ট মাস থেকে পালিয়ে আসার যে ঢল নামে সবমিলিয়ে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা এখন ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যে কারণে পুরো বিশ্বে এই রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুত জাতিগোষ্ঠী হিসাবেও স্থান পেয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের ৫ বর্গমাইল এলাকায় এদের এখন আশ্রয়স্থল। প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৩০টি আশ্রয় শিবির। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকে। আবার কেউ কেউ আশ্রয় শিবির ছেড়ে দেশের কোথাও না কোথাও নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। শুধু মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার এদের প্রাণে বাঁচাতে নিজেদের নানা সমস্যার মধ্যে এটিকে যুক্ত করে নিয়েছে। একজন রোহিঙ্গাও যাতে না খেয়ে মারা যায়Ñ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেয়নি। বরঞ্চ তাদের নিজ দেশে তারা যে অবস্থায় ছিল তারচেয়েও কিছুটা ভাল অবস্থানে রাখার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে মিয়ানমার সরকারের মনোভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক হওয়ায় এখনও সুফল মেলেনি। প্রসঙ্গত ২০১২ ও ২০১৬ সালে দেশটিতে সেনা অভিযানের কারণে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। এর আগে থেকে পালিয়ে এসে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে বাস করছিল প্রায় তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। গত বছরের ২৫ আগস্টের পর নতুন করে আসে অন্তত ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ওই রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে নিজ দেশে। স্বদেশে তারা রাষ্ট্রহীন ও জাতিগত স্বীকৃতি ছাড়াই বসবাস করে আসছিল। তাদের ওপর নৃশংসতা চলছে যুগ যুগ ধরে। এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ও পরে সেনা পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হয়েছে এ বর্বরতা। আউং সান সুচির হাতে রাষ্ট্রের বড় ক্ষমতা থাকলেও প্রকারান্তরে এখনও দেশটির মূল কর্তৃত্ব সেনা কব্জায় যে রয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। যার ফলে এমন নৃসংশ কর্মকান্ড চালিয়েও সেনাবাহিনী অব্যাহতভাবে দায়মুক্তির সুবিধা পাচ্ছে।
×