ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিজ বোমা হামলার ১৩ বছর পূর্তি আজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৭ আগস্ট ২০১৮

সিরিজ বোমা হামলার ১৩ বছর পূর্তি আজ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজ শুক্রবার সিরিজ বোমা হামলার তেরো বছর। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও থেমে নেই জঙ্গী তৎপরতা। এখনও তাদের দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশী-বিদেশী চক্রগুলো। তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। যদিও সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গীদের তৎপরতা কমে এসেছে। দেশে জঙ্গীবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এ জন্য গঠন করা হয়েছে এন্টিটেররিজম বিভাগ, কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের মতো শক্তিশালী মনিটরিং সেল। গ্রেফতারকৃত ও পলাতক জঙ্গীদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য সংরক্ষণ করতে পৃথক ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নেয়ার পর দেশে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গীরা। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট আজকের দিনে দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) বেলা এগারোটার দিকে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে দেশের পাঁচশ’ স্থানে চালানো সেই হামলায় অন্তত ৫ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলায় দু জন নিহত হন। আহত হন দু শতাধিক মানুষ। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার তথ্য মোতাবেক, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে ১০টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। বাকি ১৪৯টি মামলায় চার্জশীট দেয়া হয়। এসব মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছে এক হাজারের বেশি আসামি। আসামিদের মধ্যে ৩৩৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আর ২৭ জনের মৃত্যুদ- হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গড়ে ওঠে। সিরিজ বোমা হামলার পরেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করার সুযোগে ভেতরে ভেতরে আরও বেপরোয়া হয়ে সংগঠিত হতে থাকে জঙ্গীরা। এমন সুযোগে ওই বছরই চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও গাজীপুরে আত্মঘাতী হামলায় ২ জঙ্গীসহ ১৬ জন নিহত ও দুই শতাধিক জন আহত হন। ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় নিহত হন সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়ে। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যায় ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ সাত শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসি হয়। আতাউর রহমান সানি গোয়েন্দাদের জানায়, জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ) গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। আর সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকার সিংহভাগ এসেছে বিদেশ থেকে। যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অনেক এনজিও এর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীও নানাভাবে জড়িত। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, এন্টিটেররিজম বিভাগ ও পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স শাখার তথ্য মোতাবেক, যেভাবে অভিযান চলছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। অভিযানের কারণে জঙ্গীরা নতুন করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বর্তমানে জঙ্গীরা প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এ খাতে মনিটরিং আরও বাড়ানো দরকার। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের তথ্য মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই এক যুগ আগে জেএমবির জঙ্গীরা সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পেরেছিল। সামনের দিনগুলোতে তেমন কিছু আর জঙ্গীরা ঘটাতে পারবে না। হালে নব্য জেএমবি সক্রিয় থাকলে তারা কোন্দলে বিভক্ত। তাদের বড় ধরনের কোন নাশকতা চালানোর ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ পুলিশের এন্টিটেররিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলামের বক্তব্য, ভারতে বোমারু মিজান গ্রেফতার হওয়ায় সিরিজ বোমা হামলার আরও অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে। কারণ ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বোমারু মিজান জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান ছিল। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলবে। ভারতের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীবিরোধী গোপনে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। সিরিজ বোমার হামলার পরই জেএমবি আল কায়েদাসহ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর নজরে আসে। তবে ২০১০ সালের ২৪ মে জেএমবি আমীর মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবির তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে রাজধানীর মিরপুরের পীরেরবাগের একটি বাড়ি থেকে র‌্যাবের সঙ্গে ব্যাপক গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরণের পর গ্রেফতার হয় বোমারু মিজান। এরপর ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ নেয়ার সময় ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবি জঙ্গীরা বোমারু মিজান (৩৯), জেএমবির শুরা সদস্য দুর্ধর্ষ জঙ্গী রাকিবুল হাসান (৩৫) ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানিকে (৩৮) ছিনিয়ে নেয়। পালানোর পথে ওইদিনই মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে রাকিবুল হাসান নিহত হয়। বোমারু মিজান ও সানি আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রত্যেকের জন্য ৫ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণে দুই জেএমবি জঙ্গী শাকিল আহাম্মদ ওরফে শাকিল গাজী ও সোবাহান ম-ল ওরফে সোবাহান শেখ নিহত হন। নিহত দুই জঙ্গীর স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি গ্রেফতার হয়। তারা রিমান্ডে জানায়, বাংলাদেশের বহু জঙ্গী খাগড়াগড়ের আস্তানায় বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। কারখানায় তৈরিকৃত বহু বোমা বাংলাদেশে পাঠিয়ে তা জঙ্গীদের কাছে মজুদ করা হয়েছে। ভারত সরকার বোমারু মিজান ওরফে কাওসারকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
×