ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য যুদ্ধের অশনিসঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৯ জুলাই ২০১৮

বাণিজ্য যুদ্ধের অশনিসঙ্কেত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে সূচনা করছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকা ও চীন মহাশক্তির অধিকারী। এ দুটি দেশের মধ্যে শুরু হয়েছে আধিপত্য ও স¤্রাজ্যবাদের লড়াই। যার রোষানলে আমাদের ক্ষুদ্র দেশ পড়বে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। চীন থেকে আমদানিকৃত প্রায় ১০০টি পণ্যের উপর ৬০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আদায়ের পরিকল্পনায় সই করেছেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক খাতে পুঁজি বিনিয়োগকারী চীনা পুঁজিপতিদের ওপর কড়াকড়িও আরোপ করা হয়েছে। এদিকে চীন পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ওয়াশিংটন দ্রুত সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে বেইজিং। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পাল্টায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের ওপর নতুন করে তিন শ’ কোটি ডলার শুল্ক আরোপের চিন্তা করছে বেইজিং। যেসব পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের চিন্তা চলছে তার মধ্যে শূকরের মাংস, ওয়াইন, ফলমূল, স্টেইনলেস স্টিল পাইপের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও হার্ডওয়ার পণ্যসামগ্রী আছে। ফলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বিপজ্জনক স্থানে চলে যাচ্ছে। বেইজিং অভিযোগ করেছে, অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে এ নিয়ে অভিযোগও করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক তালিকায় যেসব চীনা পণ্য রয়েছে, তার একটি সিএফ মোটর সাইকেল। চীনের কোম্পানি ‘সি এফ মোটো’র তৈরি করা এ রকম ১২ হাজার মোটরসাইকেল এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে। কিন্তু এখন তাদের এ রকম বাণিজ্য অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সে কথাই বলেছেন কোম্পানির অন্যতম ব্যবস্থাপক গাও চিং। ‘অতিরিক্ত পঁচিশ শতাংশ ট্যাক্স অবশ্যই আমাদের ব্যবসায় অনেক প্রভাব ফেলবে। এটা আমাদের মুনাফা অনেকাংশে কমিয়ে দেবে। ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য সিএফ মোটো আমেরিকানদের চাকরির সুযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু সেটা মনে করেন না গাও চিং। তিনি আরও বলেছেন ‘আপনি যদি আমাদের কারখানাটি ভাল করে দেখেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, যে আমরা আমাদের নিজেদের যোগ্যতাতেই এ পর্যন্ত এসেছি এবং টিকে রয়েছি। সেটা আমরা করেছি আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মেনেই।’ কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটা মনে করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, নিয়মনীতি ভেঙ্গে চীনের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন চীনের প্রধান শিল্পনীতি নিয়ে, যাকে চীনারা বলছে ‘মেড ইন চায়না টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফাইভ।’ এটা রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে একটি বড় ধরনের পরিকল্পনা, যার উদ্দেশ্য বিশ্বের অর্থনীতিতে চীনের এক নম্বর হয়ে ওঠা। যার প্রধান উপাদান হবে রবোটিক্স এবং ইলেকট্রিক ভেহিকেলসের মতো প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। সাংহাইয়ের কোম্পানি ফোরইয়া ইন্টেলিজেন্স রবোটিক্স ব্যবহার করে এমন একটি বিশেষ পোশাক তৈরির চেষ্টা করছে, যেটি মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া লোকজনকে হাটতে সহায়তা করবে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা গুজিয়ে স্বীকার করেন, এটা হচ্ছে সেই ধরনের কোম্পানি, যাদের কথা চীনের ‘মেড ইন চায়না টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফাইভ’ স্লোগানে বলা হচ্ছে। তার মতে, এই স্লোগান নিয়ে অন্য দেশের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এই স্লোগান হচ্ছে চীনের উন্নয়ন ধরে রাখার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মাত্র। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের অর্থনীতিই উপকৃত হবে। তিনি বলেছেন, ‘চীন হচ্ছে একটি মানব শিশুর মতো। আপনি কখনোই একটি শিশুকে বড় হওয়া থেকে আটকে রাখতে পারবেন না। বরং সেখানে বাধা সৃষ্টি না করে, সেই উন্নয়নে সহযোগী হওয়া, অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে সঠিক পথ দেখানো ভাল, যার মাধ্যমে ভাল অংশীদার হওয়া সম্ভব।’ তবে এসবে সন্তুষ্ট নন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই মুহূর্তে তার শুল্ক তালিকায় রয়েছে সিএফ মোটোর এর মতো অনেক ভারি শিল্প পণ্য, যা এই কারখানায় তৈরি হয়। এখন চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে পাল্টা জবাব দিতে চাইছে। অন্যদিকে ট্রাম্প চীনে তৈরি প্রায় সব পণ্যের ওপরই শুল্ক আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন। কয়েক দশকের বাণিজ্য সম্পর্কের পর বিশ্বের প্রধান দুই অর্থনীতির দেশ অনিশ্চিত এক বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেখানে অর্থপূর্ণ আলোচনার কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আর কোন পক্ষই যেন নিজেদের মধ্যকার এই দেয়াল ভাঙ্গতে প্রস্তুত নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্দেশ্যে চীন বলেছে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জিতবে না। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি সংরক্ষণবাদ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছেন। উন্নয়নশীল দেশের ওপর শুল্ক অবরোধের যে হুমকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন তা নিয়েও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। এই দুই শীর্ষ নেতা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে তৈরি জোট ব্রিকসের বৈঠকে এ কথা বলেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে তিন দিনব্যাপী এ বৈঠক হয়েছে। ব্রিকস দেশগুলোতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি বাস করে, কিন্তু এই দেশগুলো কখনোই একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে কাজ করেনি। শি জিনপিং বলেছেন, ‘আমাদের এক তরফা বিশ্ব ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যানে অটল থাকতে হবে। আর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধও আমাদের প্রত্যাখ্যান করা উচিত, কারণ এতে কেউ জিতবে না। এক তরফা কোন ব্যবস্থা কেউই মেনে নেবে না। আর চীন নিজের দরজা খোলা রেখেই নিজেকে আরও বেশি উন্নত করতে থাকবে।’ উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং ক্রমবর্ধনশীল বাজারের যৌথ উত্থান কেউই আটকাতে পারবে না। আর এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য ফিরে আসবে বলে মনে করেন শি জিনপিং। ট্রাম্পের মতে- চীনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নানা কারসাজি করে শুধু জিনিস বিক্রি করা, যার পরিণতিতে আমেরিকার শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এর অবসান করতে যা যা প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্র করবে। বাণিজ্য পরিবেশ যখন আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিনির্ভর হয়, ঝুঁকিবিহীন হয়, তখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সুবিধা হয়। অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি হলে আমাদের জন্য চিন্তার। এখন যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু“হয়েছে, সেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের কিছু লাভ হতে পারে। কিছু পণ্যের দাম কমতে পারে, যা বাংলাদেশ আমদানি করে। আবার কিছু পণ্যের রফতানি বাড়তে পারে। তবে ইউরোপ-আমেরিকায় যদি পণ্যের চাহিদা কমে যায়, তাহলে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের গতি কমার আশঙ্কা থাকে। আরেকটি বিষয় হতে পারে, সেটি হলো নিজ দেশ থেকে রফতানিতে শুল্কের মুখে পড়ে চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে তাদের কারখানা সরিয়ে নেয়ার চিন্তা করতে পারে। অবশ্য আমরা সে সুযোগ কতটুকু নিতে পারব, সেটাও ভাবার বিষয়। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এখন ২০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। নানা সমস্যায় আমরা বেশি পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছি না। বাণিজ্য যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও নিয়ননীতি মানে না, তখন নানা ঘটনা ঘটে। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করছে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কথা বলে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও আছে, যারা সুরক্ষা চায়। এসব গোষ্ঠীর কেউ বাংলাদেশের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ভারসাম্য নেতিবাচক বলে বাড়তি শুল্ক আরোপের কুপরামর্শ দিতে পারে। আবার ক্যারিবিয়ান ও আফ্রিকার দেশগুলোও বাংলাদেশের ওপর শুল্ক আরোপের দাবি করতে পারে। আসলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তেমন কোন ভূমিকা নিতে পারবে না। আমরা সমপর্যায়ের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে বিশ্ববাণিজ্যে অঙ্গীকার ও নিয়মনীতির ওপর জোর দিতে পারি। নইলে বিশ্বব্যাপী যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা বিশ্বসভায় উল্লেখ করতে পারি। আমাদের আসলে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। বাণিজ্য ও ব্যবসা পরিবেশের উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে। প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
×