ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ব্যাংক দশ বছরে ১০ কেজি সোনাও নিলামে তোলেনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৪ জুলাই ২০১৮

বাংলাদেশ ব্যাংক দশ বছরে ১০ কেজি সোনাও নিলামে তোলেনি

রহিম শেখ ॥ সুযোগ থাকলেও ১০ কেজি সোনা ১০ বছরেও নিলামে তুলেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ সোনার নিলাম করেছিল ২০০৮ সালে। ওই বছর চারটি লটে ৯১ কেজি সোনা নিলাম করা হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ৯৬৩ কেজির কিছু বেশি পরিমাণ জব্দ করা সোনা আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী খাতে জমা পড়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী খাতে রয়েছে ১০ কেজি সোনা। এই সোনা নিলাম ডাকার জন্য সর্বশেষ গত দুই মাস আগে শুল্ক গোয়েন্দারা চিঠি দিলেও ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভল্টে স্বর্ণ ফেলে রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ খাত। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিলাম প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট চার হাজার ৬৪৫ কেজি বা ১১৬ মণের সামান্য বেশি সোনা জব্দ করেছে। এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করা হয়েছে। বাজেয়াফত সোনার মধ্যে দুই হাজার ২৯৯ কেজি বা ৫৭ মণ ১৯ কেজি সমসাময়িক আন্তর্জাতিক দরে কিনে সরকারকে টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে ২৪ মণ বা ৯৬৩ কেজি সোনার বিপরীতে এখন আদালতে মামলা চলছে। আর বিভিন্ন সময়ে নিলামের মাধ্যমে কিছু সোনা বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে কিছু সোনা ফেরত দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল্যবান দ্রব্য গুদাম কর্তৃপক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী খাতে ৯৬৩ কেজির কিছু বেশি সোনা জমা করা হয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অস্থায়ী খাত থেকে স্থায়ী খাতে এসেছে ২৮ কেজির কিছু বেশি সোনা। এর মধ্যে ১৫৫টি বারের ওজন ১৮ কেজির কিছু বেশি। এই বারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নেবে। বাকি ১০ কেজি সোনার অলঙ্কার নিলামের জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তাসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ মোট পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তবে ওই সোনার পরিমাপ ও মান নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা এবং তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ওই ১০ কেজি সোনার বিক্রি প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জব্দ করা সোনার কোন দাবিদার না পাওয়া পর্যন্ত সেগুলো অস্থায়ী খাতে রাখা হয়। এ বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের করা মামলা নিষ্পত্তির পর এর মালিকের অনুকূলে সোনা ফেরত দেয়ার রায় না গেলে সেগুলো বাজেয়াফত করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে মালিক ঘোষণা করা হয়। পরে ওই সোনা স্থায়ী খাতে নিয়ে নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সোনাগুলো যদি স্ট্যান্ডার্ড হলমার্ক স্টিকারযুক্ত বার আকারে থাকে, তবে সেগুলো আন্তর্জাতিক দরে কিনে নিয়ে রিজার্ভে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের কারেন্সি অফিসার আওলাদ হোসেন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, স্থায়ী খাতের সোনা আমরা নিলাম করে থাকি। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিলামপ্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রয়েছে। তিনি বলেন, স্থায়ী খাতে নিলাম করার মতো সোনা জমা না হওয়ায় গত ১০ বছরে কোন নিলাম হয়নি। তবে বর্তমানে ১০ কেজির কিছু বেশি সোনা নিলাম করার সুযোগ রয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যেহেতু এই সোনা জমা রেখেছিল, সেহেতু এই সোনার মালিক তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সোনা নিলাম করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে দেবে, যা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের আয়ের খাতে দেখাবে। পরে ওই অর্থ তারা সরকারের হিসাবে জমা করবে। সূত্র মতে, শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে গত বছর আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখা থেকে সাড়ে তেরো মণ স্বর্ণ ছাড়াও আটক করা হয় হীরাসহ মূল্যবান ধাতু। শুধু এই ঘটনাই নয় স্থল ও বিমান বন্দরে প্রায়ই ধরা পড়ছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা স্বর্ণ। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার চোরাচালান ধরা পড়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। ওই বছরের ২৩ জুলাই নেপাল থেকে আসা একটি বিমান থেকে ১২৪ কেজি ২১৬ গ্রাম সোনা আটক করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চোরাচালানটি ধরা পড়ে ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল। আটক করা এসব স্বর্ণ রাখা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। স্বাধীনতার পর থেকে জব্দ হওয়া সোনার মধ্যে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদালত থেকে বাজেয়াফত হওয়া দুই হাজার ৩০০ কেজি সোনা কিনে রিজার্ভে যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শীঘ্রই আরও ১৮ কেজি রিজার্ভে নেয়া হবে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জব্দ সোনার মধ্যে শুধু অলঙ্কার এবং প্রথম শ্রেণীর নয় এ রকম সোনার বার নিলামে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ নিলামটি হয়েছে ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই। সে সময় ২১ কেজি ৮২২ গ্রাম সোনা বিক্রি করা হয়েছিল। একই বছরে আরও তিন ধাপে ২৫, ২৫ ও ২০ কেজি সোনা নিলামে বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ২০১১ সালে পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈধ উপায়ে কোন সোনা আমদানি হয় না। এ অবস্থায় দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে এক শ্রেণীর চোরাকারবারির সহায়তায় সোনা এনে তা এখানকার বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। দীর্ঘদিনের দাবির পর সোনা আমদানির জন্য সম্প্রতি একটি নীতিমালা করা হয়েছে। দেশে সোনা আমদানির প্রক্রিয়া সহজতর না হওয়ায় বাজারে সোনার জোগান বাড়াতে জব্দ করা সোনা নিলামের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) নেতারা। ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে নিলাম ডাকার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৭ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা। পাশাপাশি চোরাচালান বন্ধে দ্রুত স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা করারও সুপারিশ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা রাজি হাসান বরাবর পাঠানো হয় ওই চিঠি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, চিঠি দেয়া হলেও ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, দেশের বাজারে স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। বাংলাশে ব্যাংক এখনও নিলামের আয়োজন করলে যথেষ্ট সারা পাবে। তিনি বলেন, বাজারদর অনুসারেই নিলামে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বর্ণ কিনে নেন ব্যবসায়ীরা।
×