ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ৮০ শতাংশ পথশিশু ‘ড্যান্ডি’ সেবনে আসক্ত!

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৭ জুলাই ২০১৮

ঢাকার ৮০ শতাংশ পথশিশু ‘ড্যান্ডি’ সেবনে আসক্ত!

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ তিনটি শিশু- রহমান, আতিক ও মনির। এদের তিনজনেরই বয়স আট থেকে দশ বছরের মধ্যে। তারা নিজেরাও জানে না তাদের বয়স কত কিংবা কে তাদের বাবা-মা। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তারা নিজেদের আবিষ্কার করেছে পথশিশু হিসেবে। নাম থাকলেও সবাই তাদের ‘টোকাই’ নামেই ডাকে। সম্প্রতি এই তিন শিশুর দেখা মিলল রাজধানীর টিটিপাড়াসংলগ্ন রাস্তার ফুটপাতে বসে নেশা করছে। তাদের হাতের মুঠোয় একটি করে পলিথিন। আর তার মধ্যে হলুদ রঙের তরল পদার্থ। ক্রমাগত তারা পলিথিনে নিজের মুখ ঢুকিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। তারা নেশাজাতীয় দ্রব্য ‘ড্যান্ডি’ সেবন করছে। শুধু রহমান আতিক কিংবা মনির নয় বরং পথশিশুদের অনেকেই ড্যান্ডি নামের নেশাদ্রব্যে আসক্ত। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার পথশিশুদের ৮০ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এমনকি ক্ষুধার কষ্ট ভুলে থাকতে এই শিশুরা নিয়মিত মাদক সেবন করে। যে বয়সে তাদের নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার কথা পরিবারহীন ও আশ্রয়হীন এসব শিশু সারাদিন ঘুরে বেড়ায় শহরের আনাচে-কানাচে। আর মাদকাসক্ত এসব পথশিশু মাত্র ৭ বছরের মধ্যেই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। অভিভাবকহীন এই শিশুদের অনেকেরই দু’বেলা খাওয়ার সুযোগ হয় না। আর এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুধার জ্বালা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তারা মাদক নিচ্ছে। রাজধানীর শাহবাগ, কমলাপুর রেলস্টেশন, মগবাজার, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকার পথশিশুদের দল বেঁধে পলিথিনে ড্যান্ডি নিয়ে রাস্তার ওপর বসেই তা সেবন করতে দেখা যায়। আতিকের কাছে মাদক গ্রহণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে, ‘সারাদিন রাস্তায় কাগজ, প্লাস্টিকের ভাঙ্গারি বোতল কুড়াই। পরে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি কইরা যে টাকা পাই তা দিয়ে ড্যান্ডি কিইন্না খাই। কোনদিন খাবার খাইতে পারি আবার কোনদিন পারি না। যেদিন খাবার পাই না সেদিন ড্যান্ডি খাই। তহন আর ক্ষুধা লাগে না।’ মাদক বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্যান্ডি স্থানীয় একটি শব্দ। এর আক্ষরিক তেমন কোন অর্থ নেই। মূলত ভারতে তৈরি ড্যান্ডরাইট নামক একটি আঠা থেকে ‘ড্যান্ডি’ শব্দের উৎপত্তি। মূলত জুতা তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য এই আঠাটি আমদানি করা হয়ে থাকে। এই আঠা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে তার গন্ধ নেয়াই হচ্ছে ড্যান্ডি সেবনকারীদের কাজ। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ড্যান্টরাইট সেবন করলে এর গন্ধে সেবনকারীর শ্বাসতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যে কারণে তাদের নাকে অন্য কোন গন্ধ কাজ করে না। এছাড়া শরীরের নেশা জাতীয় এক ধরনের অনুভূতির সঞ্চার হয়। মাদকাসক্ত পথশিশুদের নিরাময় কেন্দ্রে থাকার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ শিশুই সড়কে ঘুরে বেড়ায়। এরা যে পরিবেশে থাকে সেখানে সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আবার এদের অভিভাবকরাও বিভিন্ন মাদক বিক্রেতা চক্রের সঙ্গে জড়িত। বাড়তি আয়ের জন্য তারা সন্তানদেরও মাদক চক্রের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি জরিপের হিসাব অনুযায়ী, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ, ছিনতাইয়ে ১২ শতাংশ, মানবপাচার সহায়তা কাজে ১১ শতাংশ, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারী হিসেবে ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ। এছাড়া বোমাবাজিসহ অন্যান্য সহিংস কর্মকা-ে জড়িত ১৬ শতাংশ পথশিশু। তথ্যমতে, রাজধানীতে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে ও ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকারীভাবে সারাদেশে পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা কত তা না জানা গেলেও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ-১৪ সালের এক হিসেবে বলেছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭৫৪ পথ-শিশু রয়েছে বাংলাদেশে। অন্যদিকে, বেসরকারী সংগঠন এ্যাকশন এইড সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বলছে, ঢাকায় আড়াই লাখের মতো পথ শিশু রয়েছে। সংগঠনটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পথশিশুদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়ানো হয়। ভিক্ষা ছাড়াও চুরি, ছিনতাই এবং মাদকের ব্যবসা এদের দিয়ে করানো হচ্ছে। আমরা ওদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে কিভাবে এই শিশুদের অব্যবহার করা হচ্ছে। এসব শিশু একটা সহজ টার্গেট এসব অপরাধী চক্রগুলোর জন্য। তিনি আরও বলেন, মূলত সঠিক পরিবেশে বেড়ে না ওঠার কারণেই তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। শুধু যে ছেলে শিশুরাই ড্যান্ডি কিংবা বিভিন্ন মাদকে জড়াচ্ছে তা কিন্তু নয় মেয়ে শিশুরাও রয়েছে। আর মেয়ে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তাদের ওপর যে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন হয় সেটা নিয়ে আমরা বেশি আতঙ্কগ্রস্ত।’ শিশুদের পথ-শিশু হওয়ার কারণ মূলত কয়েকটি রয়েছে। এ্যাকশন এইড বলছে- গ্রামে দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়ায় গ্রাম থেকে শহরে মানুষ চলে আসছে কাজের খোঁজে। অনেক শিশু পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এসেছে তারপর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুদের জন্য সেখানে বরাদ্দ আছে মাত্র দশটি আসন। আর এ ১০ আসনের সব কটিতেই বর্তমানে মাদকাসক্ত পথশিশুদের চিকিৎসা চলছে। এদের সবাই ড্যান্ডিতে আসক্ত ছিল। এদের চিকিৎসায় কাউন্সেলিং, মেডিটেশন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যে, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী পথশিশুরা গাঁজা, সিগারেট, ড্যান্ডির মতো মাদক বেশি গ্রহণ করছে। আর ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ফেনসিডিল, হেরোইনে আসক্ত। এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরা এই পথশিশুদের মাদক বিক্রির কাজেও ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, নগরীর পথশিশুদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন সেবন করে। আর ৮ শতাংশ সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নিচ্ছে। বিভিন্ন মাদকের মধ্যে পথশিশুরা গাঁজা, হেরোইন, ঘুমের বড়ি ও ড্যান্ডির মতো মাদকে বেশি আসক্ত। বাংলাদেশে পথ-শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য সরকারী-বেসরকারীভাবে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কয়েক স্থানে তৈরি করা হয়েছে পথ-শিশুদের জন্য হোম বা আশ্রয়কেন্দ্র। ঢাকার কাওরানবাজারে এবং কমলাপুরে দুটি সরকারী হোম রয়েছে পথশিশুদের জন্য। যেখানে তাদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামক একটি সংগঠনের অধীনেও এসব ছিন্নমূল শিশুর জন্য রয়েছে হোম। যেখানে সারাদিন কাজের পর মিলিত হয়ে একসঙ্গে রাত কাটায় এসব শিশু। এছাড়া দুপুরে ও রাতে রয়েছে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও। এ পর্যন্ত এ সংস্থাটি ১ হাজার ৭৬ পথশিশু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। মহিলা এবং শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানীতে রয়েছে পথ-শিশু পুনর্বাসনের জন্য দুটি সেন্টার। কিন্তু সারাদেশে আরও কয়েক লাখ যে পথ-শিশু রয়েছে তাদের জন্য কি ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার? এ বিষয়ে কার্যক্রমের পরিচালক ড. আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘৫ বছর মেয়াদী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সারাদেশে ১৯ শেল্টার হোম তৈরি করা হবে। তবে তারা যে অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমাদের কাজ তাদের মোটিভেট করা। আমরা সেটা করছি। আমাদের মোবাইল টিম আছে যারা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে শিশুদের মধ্যে সেই কাজটি করছি’।
×