ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাতার মঞ্চে অবিস্মরণীয় ‘হেলেন কেলার’

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৫ জুলাই ২০১৮

কলকাতার মঞ্চে অবিস্মরণীয় ‘হেলেন কেলার’

বিশ্বের বুকে একজন কিংবদন্তি ও বিস্ময়নারী- হেলেন কেলার, যার জীবন সংগ্রামে বারেবারে উঠে এসেছে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যুদ্ধ-ধ্বংস-আণবিক অস্ত্রসহ সকল অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানবতাবাদ, সমতা, নবজাগরণ, নারীশক্তির উত্থান তথা জীবনের জয়গান। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিনই তাই এ মহীয়সী হবেন সম্মানের সঙ্গে স্মরণীয়-বরণীয়! কিন্তু আমার বর্তমান লেখায় ‘অবিস্মরণীয়’ শব্দটির ব্যবহার যে নাট্যপ্রযোজনা, নাটক তথা অভিনয়কে ঘিরে এবং বলাযায় যে সৃজনের বিস্ময় বা ঘোর আমার মধ্যে এখনও অটুট তা অবশ্যই কলকাতার মঞ্চে দেখা হেলেন কেলারের জীবনীনির্ভর বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যসংগঠন ‘স্বপ্নদল’-এর প্রযোজনা ‘হেলেন কেলার’। অপূর্ব কুমার কুন্ড রচিত মনোড্রামা (একক অভিনীত প্রযোজনা) ‘হেলেন কেলার’ বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরেও অতি-জনপ্রিয় ও দক্ষ পরিচালক জাহিদ রিপন কর্তৃক নির্দেশিত। আর অসামান্য অভিনয়, বাচনও যথার্থ দেহভঙ্গিমা সহযোগে জুয়েনা শবনম এ নাট্য প্রযোজনার অনন্যসম্পদ! ভিনদেশ থেকে ‘হেলেন কেলার’ প্রযোজনার সুনাম কিছুটা জানা থাকলেও প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হলো গত ২৮ জুন বৃহস্পতিবার কলকাতার ইস্টার্ন জোন কালচারাল সেন্টারের (ইজেডসিসি) পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগ্রহে। ভারতের স্বনামধন্য নাট্যদল ‘প্রাচ্য নিউআলিপুর’ এখানে আয়োজন করেছিল তাদের সপ্তাহব্যাপী ৫ম আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ‘পূবের নাট্যগাথা’। সমাপনী দিনে হলো ‘হেলেন কেলার’-এর মঞ্চায়ন। এবারের ‘পূবের নাট্যগাথা’-র থিমটিও ছিল অভিনব- উৎসবের সাতটি প্রযোজনাই বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের রচনা নিয়ে সমৃদ্ধ! নয়ে নাটুয়ার ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ নাট্যলোকের ‘রূপসুন্দরী’, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ‘চম্পাবতী’, বিবর্তন যশোরের ‘মাতব্রিং’ এবং স্বপ্নদলের ‘হেলেন কেলার’ মঞ্চস্থ হলো এ উৎসবে। আগেই বলেছি, স্বপ্নদলের ‘হেলেন কেলার’-এর মুখ্যবিষয় অনন্য নারী হেলেনের জীবন-কর্ম-স্বপ্ন-সংগ্রাম ও জীবনদর্শন। দৃষ্টি-বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কেবল প্রবল আত্মবিশ^াস আর শিক্ষিকা এ্যান সুলিভানের অতি-মানবিক প্রেরণায় হেলেনের সকল নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী যার উপজীব্য। এ্যান সুলিভানের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটিকেই হেলেন কেলার আমৃত্যু এ শিক্ষিকার জন্মদিন হিসেবে পালন করে গেছেন। এটি বাস্তবের সত্য। এই সত্য থেকেই নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুন্ড তার নাট্যকাহিনী বুননের সূত্র নিয়েছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে সাজিয়েছেন। নাটকে হেলেন কেলারের একাকী এমনই এক জন্মদিন পালনের প্রাক্কালে শিক্ষিকা এ্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষ্যে ক্রমশ প্রকাশিত হয় চার্লি চ্যাপলিন, মার্ক টোয়েন, কেনেডি, আইনস্টাইন প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে তার জীবনের সমৃদ্ধির কথা। আমরা পেয়ে যাই হেলেন কেলারের সমকালীন বিশে^র অতিসুচারু এক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা! নাটকের প্রারম্ভে নির্দেশক তার ভাষ্যে যেমন বলেছিলেন যে, সমগ্রবিশ্বে অনন্য সাধারণ হেলেন কেলারকে নিয়ে অনেক সৃজন হলেও স্বপ্নদলের এ প্রযোজনার মূল-গবেষণা পাশ্চাত্যের হেলেন কেলারের জীবনে প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্র দর্শনের প্রবল প্রভাব; আমরাতা ক্রমশই উন্মোচিত হতে দেখি মঞ্চে। রবীন্দ্রনাথের প্রায়-অজানা এক অধ্যায় উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে আমরা যেন পেয়ে যাই দেশ কাল সীমার বাইরে অত্যন্ত কাছের আপনজন এক অনন্য হেলেন কেলারকে! পাশ্চাত্যের এক নারীর জীবনেও রবীন্দ্রনাথ কীভাবে শক্তি জোগান,আর কীভাবে অন্তর থেকে উৎসারিত পরমশ্রদ্ধায় ‘গুরুদেব’ হয়ে ওঠেন তা রবীন্দ্রদর্শনের অনিবার্যতা সম্পর্কে নিশ্চিয়ই আমাদের নতুন করে ভাবায়। ‘হেলেন কেলার’-এর একমাত্র অভিনেত্রী জুয়েনা শবনমের অভিনয় উপস্থাপনা সম্পর্কে বলা য়ায় যে, টানা একটি ঘণ্টা শুধুমাত্র এক আসাধারণ দেহভঙ্গিমা, বাচনভঙ্গি ও অভিব্যক্তি পেয়ে নিষ্পলক মুগ্ধতায় কাটিয়েছি আমি। প্রতিটি প্রপস ও পোশাকের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এক-একটি ঘটনাকে সাবলীল ভঙ্গিমায় এঁকে যাচ্ছিল জুয়েনা। মঞ্চে যথাযথ সেট না পেয়েও (পরে জেনেছি তারা কলকতায় বিকল্প সেট দিয়ে অভিনয় করেছেন) একের পর এক নিজের ইম্প্রোভাইজেশনে দর্শককে নিশ্চুপ করে বসিয়ে রাখা, আমার কাছে অবশ্যই দক্ষতা ও নিষ্ঠা এবং সত্যিকারের থিয়েটারপ্রেমী একজন সুহৃদ-গুণী অভিনেত্রী হিসেবেই তাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। সারপ্রাইজ আস মোর এ্যান্ড মোর- ডিয়ার-জুয়েনা! আমি অবশ্যই তোমার ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘ত্রিংশশতাব্দী’ প্রভৃতি প্রযোজনা দেখার জন্যও অপেক্ষা করব। মূলনাটকের ভিত্তিতে মঞ্চে যে সেট ও প্রপস পরিকল্পনা হয়েছে, তাকে সুচারুভাবে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন পরিচালক। আলো ও সঙ্গীত যথেষ্ট প্রশংসনীয়। বিশেষ করে দুর্লভ নানা ছবি ও ভিডিওসহ প্রজেক্টরের এফেক্ট এবং তার প্রয়োগ সত্যিই অভিনব, বলা যায় মনোড্রামার ক্ষেত্রে এটি সত্যিই যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা! অবশ্যই ভাল লেগেছে হেলেনের অন্ধজীবনের বিপরীতে ‘আলো’র সঙ্গে সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ব্যবহারের দিকটি ও গানগুলোর মনোনয়ন। আমি তাই আবারও বলি, অভূতপূর্ব ‘হেলেন কেলার’-এর মঞ্চায়ন ও দৃশ্যায়ন-বহুদিন এই কাজকে মনে রাখব- পরিচালক জাহিদ রিপনকে কুর্নিশ!
×