ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে বাহারি নামের অপরাধী চক্রের তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১০ জুন ২০১৮

বাড়ছে বাহারি নামের অপরাধী চক্রের তৎপরতা

শংকর কুমার দে ॥ ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৎপরতা বাড়াচ্ছে অপরাধ জগতের নানা ধরনের বাহারি নামের অপরাধী চক্র। বাহারি নামের অপরাধী চক্রের মধ্যে আছে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টি, পা পাড়া পার্টি, ল্যাং মারা পার্টি, ঢিল পার্টি, হাফ প্যান্ট পার্টি, টানা পার্টি, ছোঁ মারা পার্টি, ডলার পার্টি, লাগেজ পার্টি ইত্যাদি। রাজধানীতে এ ধরনের নামের এক ডজনেরও বেশি অপরাধী চক্র সক্রিয়। রাজধানীতে কেনাকাটার ধুমধামের মধ্যে অপরাধ জগতে নেমে পড়েছে নানা ধরনের বাহারি নামের অপরাধী চক্র। রাজধানীতে গ্রেফতার হওয়া অপরাধীর কাছ থেকে এ ধরনের অপরাধী চক্রের নামের তালিকা পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঈদ উপলক্ষে চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে বিপণিবিতান, রাস্তা ঘাটও টার্মিনালে এ ধরনের অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই রিক্ত ও নিঃস্ব হয়েছে, হতাহতের মতো ঘটনাও ঘটছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটকাটা, প্রতারণাসহ নানা ধরনের অপরাধ করে চারদিকে ঘুরে বেড়ায় বাহারি নামের এ ধরনের অপরাধী লোকজন। লঞ্চ টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনালের মতো স্থানে টানা পার্টি, থুথু পার্টি, ল্যাং মারা, পা পাড়া পার্টির দৌরাত্ম্য বেশি দেখা যায়। এ সব অপরাধীরা গাঁয়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়। দলবদ্ধ হয়ে কোন ব্যক্তিকে ঘিরে ধরে নানা কৌশলে মানুষজনের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে সর্বস্ব কেড়ে নেয় তারা। সব অপরাধী সংঘবদ্ধ। এ কারণে এই বাহারি নামের অপরাধীদের প্রতিরোধ করতে পারেন না পথচারীরা। প্রকাশ্য দিবালোকে ওদের তৎপরতা। কখনও কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পথচারী মানুষজনের সামনেই নানা ছলচাতুরি করে তাদের সংঘবদ্ধ দলের সদস্যরা একত্রিত হয়ে উল্টো তাদের প্রতিরোধ করে কিংবা প্রতিবাদ জানিয়ে তাদেরই অপরাধী বানিয়ে দেয়। ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে কথিত অজ্ঞান পার্টির ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটককৃতরা হলো মিজানুর রহমান, আলমগীর হোসেন, ইদ্রিস ব্যাপারী, খোকন মোল্লা, আবুল কালাম মিয়া, বাবুল পাটোয়ারি, শাহ আলম শেখ, আব্দুল মান্নান, মোঃ রিপন, মোঃ শরিফ, হুমায়ুন কবির, আব্দুর রহমান, ইউনূস মিয়া, মোঃ শ্যামল ও মাঈনুল ইসলাম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশ ও ডিএমপি পুলিশ রাজধানীর জুরাইন, মগবাজার মোড়, ফকিরাপুল ও মৌচাক এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে তাদের। গ্রেফতারের পর তারা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সারা বছর তাদের কর্মকা- চালালেও ঈদ ও রমজানকে গুরুত্ব দিয়ে টার্গেট করে থাকে। প্রথমে তারা রোজাদার ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। ইফতারের আগ মুহূর্তে টার্গেট ব্যক্তিকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে আগে তৈরি করা খাবার খাওয়ায়। যখন ওই ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়ে তখন তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে পালিয়ে যায়। ডিএমপি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের গ্রেফতারকৃতরা জানায়, আটককৃতরা ইফতারের কিছু আগে একজন বাসযাত্রীকে টার্গেট করে তার পাশে বসে। কথায় কথায় সখ্য তৈরি করে। মাগরিবের আজান পড়লে, বাসযাত্রীকে ইফতারের খাবার অফার করে। ওই খাবারে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো থাকে। বাসযাত্রী ওই খাবার খেলেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বাসে যেসব হকার খাবার বিক্রি করে তাদের মধ্যেমেও চেতনানাশক মেশানো খাবার বাসযাত্রীদের কাছে বিক্রি করে থাকে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও অনেক সময়ে মলম পার্টি বা বাহারি নামের অপরাধী চক্র সেজে অপরাধ করে বেড়ায়। সারা বছর ধরে তারা বাহারি নামের অপরাধী চক্র সেজে অপরাধ করে বেড়ালেও ঈদকে সামনে রেখে রমজান মাসে তাদের অপরাধী তৎপরতা বেড়ে যায়। ডিবির তালিকা থেকে জানা গেছে, অপরাধ সংগঠিত করার ধরনের সঙ্গে অপরাধী চক্রের নামের সাদৃশ্য থাকায় এসব নামকরণ করা হয়েছে। যেমন অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির নাম ব্যাপক তৎপরতার কারণে খুবই পরিচিত লাভ করেছে অপরাধ জগতে। কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব খুইয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে নামকরণ হয়েছে অজ্ঞান পার্টির। তেমনি চোখে মলম দিয়ে জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধীদের নাম দেয়া হয়েছে মলম পার্টি। হাফ প্যান্ট পার্টি সাধারণত রাতের বেলায় ডাকাতি করে বেড়ায়। ডলার পার্টি লোভ দেখিয়ে কম দামের ডলার বা টাকা দেয়ার নাম করে জাল নোট দিয়ে সটকে পড়ে। ডলার পার্টির কাজ হচ্ছে স্রেফ প্রতারণা। ঢিল পার্টি গাড়িতে ঢিল ছুরে গাড়ির গতিরোধ করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। ছোঁ মারা পার্টি চলন্ত রিক্সা বা হোন্ডা কিংবা বেবিট্যাক্সি আরোহীদের ছোঁ মেরে ছিনতাই করে নিয়ে দ্রতগতিতে অদৃশ হয়ে যায়। আবার ধাক্কা পার্টি আছে, যারা গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঝগড় বাধিয়ে অপরাধীরা দলবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধকারীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন টিম বাহারি নামের অপরাধ দমনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ডিবির নেতৃত্বাধীন টিমগুলো রাজধানীর এসব অপরাধীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাহারি নাম পেয়েছে। প্রতিটি অপরাধী দলে ৫ থেকে ৭ জন করে সদস্য থাকে। একজন দল নেতা তাদের নেতৃত্ব দেয়। রাজধানীতে প্রায়ই পথচারী, রিক্সা বা সিএনজি আরোহীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজন এসব বাহারি নামের অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে। তবে এসব অপরাধ খুব বড় ধরনের না হওয়ায় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের শরণাপন্ন হন না। এ কারণে এ ধরনের অপরাধী চক্রের তৎপরতার বিষয়গুলো থানা পুলিশের খাতায় রেকর্ডও হয় কদাচিৎ। লাগেজ পার্টি কীভাবে কোথায় অপরাধ সংগঠিত করে তার কথা কম বেশি জানেন আকাশ পথের যাত্রীরা। অতিতে আকাশ পথের যাত্রীদের মধ্যে একাধিকবার বিদেশে গেছেন, এমন যাত্রী খুব কমই আছেন, যারা লাগেজ পার্টির খপ্পরে পড়েনি। বর্তমানে আকাশ পথের চেয়ে স্থল ও নৌপথের যাত্রীদের লাগেজ কেটে লাগেজের মালামাল নিয়ে যায় লাগেজ পার্টির সদস্যরা। অতিতে লাগেজ পার্টিতে বিমান বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে বেশি। অতীতের লাগেজ পার্টির তৎপরতা আকাশ পথের যাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তাদের তৎপরতা লঞ্চঘাট, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনালের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব স্থানের যাত্রীদের যেসব লাগেজ থাকে তা তারা কৌশলে কেটে মালামাল নিয়ে চম্পট দেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অপরাধের ধরনের সঙ্গে নামের মিল রেখে গড়ে উঠেছে রাজধানীতে বিভিন্ন বাহারি নামের অপরাধী চক্র। এসব অপরাধী চক্র দমনের জন্য পুলিশ ও ডিবির একাধিক টিম কাজ করে যাচ্ছে। বাহারি নামের অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করার অভিযান অব্যাহত আছে। এসব অপরাধীদের গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করে অপরাধী চক্রের বাহারি নাম পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অপরাধীর চক্রের সংগঠিত অপরাধের ধরনের সঙ্গে মিল রেখে, গড়ে উঠেছে বাহারি নামের অপরাধী চক্র। মাদকাসক্ত, ছিঁচকে, দরিদ্র শ্রেণীর অপরাধীরাই সাধারণত বাহারি নামের অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত। ঈদের সময়ের বাড়ি ফেরা, কেনাকাটা, আনন্দ উৎসবের ধুমধামের ঢামাঢোলের মধ্যে বাহারি নামের অপরাধী চক্রের তৎপরতাও বেড়ে যেতে দেখা যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন টিম ঈদের কেনাকাটা নিরুপদ্রব ও নিষ্কণ্টক করতে রমজানের শুরু থেকেই রাজধানীতে বাহারি নামের অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান চলছে।
×