ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় কারাগারে বন্দী ;###;দলের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন পুত্র তারেক রহমান, যিনি সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ;###;রাজনীতিতে নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন

মহাসঙ্কটে বিএনপি ॥ কানাডার কোর্টে ফের সন্ত্রাসী দলের তকমা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৫ মে ২০১৮

মহাসঙ্কটে বিএনপি ॥ কানাডার কোর্টে ফের সন্ত্রাসী দলের তকমা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একদিকে দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি অন্যদিকে দফায় দফায় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে কানাডার আদালতের রায়ে রাজনীতিতে বিএনপির নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা পাওয়া একটি দলের সঠিক রাজনৈতিক চেহারা নিয়েও। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বিএনপির এমন সন্ত্রাসীমূলক চেহারায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন। এমন একটি দলের নিবন্ধন ও রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ও কানাডার আদালতের রায় দেশের জন্য এলার্মিং। উগ্রবাদীদের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা ও নাশকতার ফল এ রায়, যা বিএনপির জন্য নেতিবাচক ও লজ্জাজনক। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বিএনপির ধারাবাহিক নাশকতামূলত তৎপরতা ও উগ্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার ফলে আজ বিদেশে দেশের রাজনৈতিক দলের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিএনপিকে ভাবতে হবে তারা কি উগ্র সংগঠনের সঙ্গেই থাকবে নাকি সুস্থ রাজনৈতিক চেহারা নিয়ে সক্রিয় হবে। অনেকে এই মুহূর্তে বিএনপিকে একটি অকার্যকর দল হিসেবেও অভিহিত করে বলেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত আইনে দলীয় প্রধানের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয় যেমন নেই তেমনি এভাবে সন্ত্রাসী চেহারা নিয়ে একটি দল থাকতে পারে কিনা তাও নেই, যা চিন্তার বিষয়। এ বিষয়ে দেশের সুশীল সমাজকে সোচ্চার হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বিএনপির বর্তমান অবস্থা নিয়ে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৮ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে যান। এরপর থেকে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন চিকিৎসার কথা বলে। ১০ বছর ধরে চিকিৎসা করার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময় এমনকি আদালতে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপির পক্ষ থেকে সব সময়েই বলা হয়েছে, সেখানে তাদের নেতা তারেক রহমান চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরবেন। এরই মধ্যে হাইকোর্ট দুই বছর আগে মুদ্রাপাচারের এক মামলায় তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে সাত বছরের কারাদ- দেয়। আর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে ১০ বছরের কারাদ- দেয় জজ আদালত। ওই মামলাতেই পাঁচ বছরের সাজার রায়ের পর থেকে কারাগারে আছেন তারেক রহমানের মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানই পদাধিকার বলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডন থেকে দল পরিচালনায় নির্দেশনা দিচ্ছেন। আগে দলটির গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রধান হিসেবে কোন দুর্নীতিগ্রস্ত সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এবার তারেক রহমানকে দায়িত্ব দিতে রাতারাতি অপরাধীর জন্য সেই পথ খুলে দেয়া হয়। সংশোধন করা হয় বিএনপির গঠনতন্ত্র। সম্প্রতি এখন অনেকটা বেকায়দায় পড়েই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে যে তারেক রহমান লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। এটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন প্রায় ৫ বছর আগে। বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন বাধ্য হয়েই বিএনপির তরফ থেকে প্রথমবারের মতো জানানো হলো, যে আরও প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন। ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতেই গত সোমবার বিএনপিকে তৃতীয়বারের মতো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে রায় দিয়েছে কানাডার ফেডারেল আদালত। বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আগের দেয়া রায় আদালত বহাল রেখেছে। দেশটিতে আশ্রয়প্রার্থী বিএনপিকর্মী মোস্তফা কামালের পক্ষ থেকে করা একটি রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে আবেদনটি খারিজ করে এ রায় দিয়েছে ফেডারেল আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, তিনি (মোস্তফা কামাল) বাংলাদেশে বিএনপি নামে যে রাজনৈতিক দলের সদস্য পরিচয়ে আশ্রয় চাচ্ছেন, সেই রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যুক্ত। এ নিয়ে কানাডার আদালতে তৃতীয়বারের মতো ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষিত হলো বিএনপি। প্রতিবারই বিএনপির সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তিনজন। কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী বিএনপি নেতা মোঃ মোস্তফা কামালের পক্ষ থেকে করা রিভিউ আবেদনের রায়ে পূর্বের অবস্থানে থাকার বিষয়টি ইতোমধ্যেই আদালত নিজেদের ওয়েবসাইটে জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি মোস্তফা কামালের রিভিউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন খারিজ করে এ রায় দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী হন মোঃ মোস্তফা কামাল। তার বিষয়ে কানাডার সরকার আদালতকে আগেই বলেছিল, বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাতেও দলটি চেষ্টা করছে বলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে। জানা গেছে, তৃতীয়বারের মতো দেয়া রায়ে তিনবারই বিএনপির সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তিনজন। প্রতিবারই আদালত বলেছে, বিএনপির সদস্যকে আশ্রয় দিলে সে দেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। প্রতিবার শুনানিতে বাংলাদেশে বিএনপির ডাকে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক নাশকতার কথা তুলে ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনের কাজ। তার সদস্যদের তারা আশ্রয় দিতে পারেন না। কানাডার আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যে সংগঠন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, আছে বা ভবিষ্যতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে, তাহলে তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে সে দেশে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। সবশেষ রায়টি সোমবার ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি অন্যদিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে কানাডার আদালতের রায়ের পর বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে জোরেশোরে। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকুক আর বাইরেই থাকুক বিএনপি সব সময় উগ্রসন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে। নিজেরা নাশকতায় জড়িত হয়ে পড়ে। ক্ষমতাথাকালীন দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল বিএনপি। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামিসহ জঙ্গীবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে জোট গঠন করে তারা রাজনীতি করে। সুতরাং নৈতিক জায়গা থেকে বিএনপি দুর্বল ভিত্তির ওপর অবস্থান করে। দেশ ও মানুষের স্বার্থে দলটিকে এই ধরনের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে হবে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করে যারা রাজনীতি করে তাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যাই বলা হোক না কেন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে এটিকে সন্ত্রাসই বলা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ড. ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতিগ্রস্ত সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন ও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি হয়েও তারেক রহমানের দলীয় পদ গ্রহণকে আগেই অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছিলেন। কানাডার আদালতের রায়ের পর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এমনিতেই একটা সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে আছে। কানাডার আদালতের রায়ের পর বিএনপির সঙ্কট আরও ঘনিভূত হবে। প্রশ্ন উঠবেই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির আস্থা নিয়ে। দেশের জন্য এ রায় এলার্মিং একটি বিষয়। তাই আমি মনে করি, ক্ষমতায় থাকুক আর বাইরেই থাকুক বিএনপি সব সময় উগ্র সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করে বলে যে অভিযোগ আছে এই রায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে কিনা বিএনপিতে তা ভাবার সময় চলে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ ‘জানিপপ’-এর চেয়ারম্যান ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিএনপির অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত আসামি আবার বিদেশের একটি আদালতে টানা তিনবার সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হলে একটি দলের কোন বৈধ অবস্থান থাকে না মানুষের কাছে। সেই দলের নিবন্ধনও হয় নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কানাডার আদালতের রায় দেশের জন্য বিব্রতকর একটি বিষয়। যে দলই হোক তাকে হতে হবে আদর্শভিত্তিক। কিন্তু একটি দলের কাজ যদি হয় ফৌজদাবি অপরাধমূলক। তাহলে তা সমাজ গ্রহণ করতে পারে না। তার অবস্থান নিয়ে ভাববার সময় হয়েছে। আমি মনে করি এ বিষয় আজ জোরালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের সুশীল সমাজেরও এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া জরুরী বলে আমি মনে করি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলছিলেন, বিএনপি এমনিতেই এখন একটি অকার্যকর দলে পরিণত হয়েছে। এক মন্ত্রীর ভাষায় কোমর ভাঙা দল। কানাডার আদালতের রায় আমাদের দেশের জন্য এলার্মিং, লজ্জার একটি বিষয়। বিএনপির জন্য এ ঘটনা অত্যন্ত নেতিবাচক একটি ঘটনা। যা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। এ ধরনের চিত্র যে কোন দলের জন্য নৈতিবাচক, উদ্বেগজনক দেশের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজ মারজান বলছিলেন, ক্ষমতায় থাকুক আর বাইরেই থাকুক বিএনপি সব সময় উগ্রসন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছে। নিজেরা নাশকতায় জড়িত হয়ে পরে। ২১ আগস্ট, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, কিবরিয়া হত্যা, বোমা হামলা, নাশকতার সঙ্গে দলটি জড়িত হয়েছে। সুতরাং একটি সন্ত্রাসীমূলক জায়গা থেকেই বিএনপি কাজ করেছে বলে মনে করে সকলে। আজকের ঘটনা যেমন দেশের জন্য উদ্বেগের তেমনি বিএনপির জন্য লজ্জার। এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে যারা কাজ করেন তারা কাজ করতে পারবেন। এমন রাজনৈতিক অবস্থান কতটা গ্রহণযোগ্য। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল বিএনপি। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন করে তারা রাজনীতি করে। সুতরাং নৈতিক জায়গা থেকে বিএনপির দুর্বল ভিত্তির উপরে অবস্থান করে। দেশ ও মানুষের স্বার্থে দলটিকে এই ধরনের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে হবে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করে যারা রাজনীতি করে তাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যাই বলা হোক না কেন, আন্তর্জাতিক স্টান্ডার্ডে এটিকে সন্ত্রাস বলা হবেই।
×