ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষ্ণচূড়া

চোখ ধাঁধানো টকটকে লাল, সবুজ পাতায় যেন জ্বলন্ত আগুন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৫ মে ২০১৮

চোখ ধাঁধানো টকটকে লাল, সবুজ পাতায় যেন জ্বলন্ত আগুন

খোকন আহম্মেদ হীরা ও শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ কবিগুরুর ভাষায় ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মতো উড়ে/ তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি’। কিংবা ‘কৃষ্ণচূড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে-তুমি আসবে বলে’ জনপ্রিয় এই গানেই ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার প্রতি আবেগঘন ভালবাসা ও তার রূপ দর্শনে প্রতীক্ষার কাক্সিক্ষত চিত্র। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশ থেকে শুরু করে নগরীসহ গ্রামের পথে প্রান্তরে চোখ ধাঁধানো টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে সেজেছে গ্রীষ্মের প্রকৃতি। এই সময়টায় পথে-প্রান্তরে ফোটা কৃষ্ণচূড়া দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বৈশাখের রোদ্দুরের সবটুকু উত্তাপ গায়ে মেখে নিয়েছে রক্তিম পুষ্পরাজি; সবুজ চিরল পাতার মাঝে যেন আগুন জ্বলছে। গ্রীষ্মের ঘামঝরা দুপুরে কৃষ্ণচূড়ার ছায়া যেন প্রশান্তি এনে দেয় অবসন্ন পথিকের মনে। তাপদাহে ওষ্ঠাগত পথচারীরা পুলকিত নয়নে, অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করেন এই সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া তিনটি রঙের হয়। লাল, হলুদ ও সাদা। কম হলেও চোখে পড়ে হলদে রঙের কৃষ্ণচূড়া আর সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে কালেভদ্রে। তিন রঙের কৃষ্ণচূড়ার গাছ উঁচু। অনেকটা জায়গা জুড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। তিন রঙেরই ফুল ফোটে প্রায় একই সময়ে। বসস্ত শেষে ও গ্রীষ্মে রোদের তাপদাহের মধ্যেও আনন্দ দেয় কৃষ্ণচূড়া। এর বড় খ্যাতি হলো গ্রীষ্মের প্রচ- তাপদাহে যখন এই ফুল ফোটে তখন এর রূপে মুগ্ধ হয়ে পথচারীরাও থমকে তাকাতে বাধ্য হন। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে। ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, আফ্রিকা, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে এটি জন্মে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণচূড়া শুধু দক্ষিণ ফ্লোরিডা, দক্ষিণ পশ্চিম ফ্লোরিডা, টেক্সাসের রিও গ্রান্ড উপত্যকায় পাওয়া যায়। সৌন্দর্যবর্ধক গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটির ব্যাপ্তি বেশ প্রশস্ত। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যে পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় ৭/৮টি পাপড়িযুক্ত গাঢ় লাল। ফুলের ভেতরের অংশ হালকা হলুদ ও রক্তিম হয়ে থাকে। পাঁপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিলপত্র বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ। কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মতো উড়ে/তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি’ আজ টিকে আছে নড়বড়ে অস্তিত্ব নিয়ে। বৃক্ষ নিধনের শিকার হয়ে দিন দিন কমে যাচ্ছে রঙিন ফুলের এ গাছ। একসময় এ গাছ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন পরিবেশবাদীরা। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানুষ ও প্রকৃতির স্বার্থেই বেশি করে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। গফরগাঁও, ময়মনসিংহ ॥ বাংলার বিচিত্র রূপকে দৃশ্যমান করে তোলে ষড়ঋতু। প্রত্যেক ঋতুই তার নিজস্ব সৌন্দর্যে বিদ্যমান। সবুজ শ্যামল গ্রামগুলোতে সব সময় শোভা পায় জানা-অজানা ফুল ও ফল। তেমনি একটি ফুলের নাম কৃষ্ণচূড়া। দোয়েল-কোয়েল প্রভৃতি পাখি মাতিয়ে রাখে প্রকৃতিকে-ছায়ায় বসে ক্লান্ত পথিক দেহ-মনের প্রশান্তি দূর করে। কবি দিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন ‘রোদ যেন নয় শুধু ঘন ঘন ফুলকি/আগুনের ঘোড়া যেন ছুটে চলে দুলকি।’ বাংলার প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখতে ফুলকির মতো। চারদিকে পথে ঘাটে রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছ ও ফুল দেখে মনে হয় যেন গ্রীষ্মে প্রকৃতিতে আগুন লেগেছে। এ ফুল সুন্দরী রমণীরা মাথায় খোঁপায় বেঁধে আনন্দ পায়। পরিবেশবিদরা বলেন, বাংলার ষড়ঋতুতে বসন্তেও গ্রীষ্মে প্রকৃতিতে আগুন লাগে। ফুল ফুটে গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া, কামিনী, বেলী, হাসনা-হেনা ফুল, উদার আকাশের নিচে সুগন্ধি জমিনে প্রকৃতির মনে আগুন লাগিয়ে দেয়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে গ্রীষ্ম, বর্ষায় কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটলেও বসন্তের গোড়াতেই কৃষ্ণচূড়া ফুল দিগন্ত রাঙ্গিয়ে ওঠে। ময়মনসিংহের গফরগাঁও-ভালুকা সড়ক, গফরগাঁও-ময়মনসিংহ সড়ক, গফরগাঁও-হোসেনপুর সড়ক ছাড়াও গফরগাঁওমুখী সড়কের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ বসন্তের পাশাপাশি এ অঞ্চলে পরিবেশ রাঙ্গিয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়া। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ববিদ প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুর রহিম জনকণ্ঠকে জানান, আবহাওয়ার কারণেই মূলত কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে একটু দেরি হয়েছে। তিনি বলেন, বর্ষাকাল পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল আসে। তবে শুরুটা এপ্রিল থেকে। কৃষ্ণচূড়া সৌন্দর্যবর্ধক গুণ ছাড়াও এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়াকে দেখলে মনে হয় যেন কোন আগুনের জ¦লন্ত শিখা। ইংরেজীতে যথার্থই একে অগ্নিশিখা গাছ বলা হয়ে থাকে। হিন্দিতে একে গুলমোহর নামে ডাকা হয়। যেখানে ‘গুল’ মানে ফুল আর ‘মোহর’ মানে ময়ূর। কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাঁপড়ির সঙ্গে যদি ময়ূরের বাহ্যিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখা হয় তবে সহজেই বোঝা যাবে। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, ভিয়েতনাম, মিসর, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রাজিল, আফ্রিকা, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা, দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্লোরিডা প্রভৃতি দেশে এটি জন্মে থাকে।
×