ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিষেধের পরও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে তথ্য প্রকাশ

এবার রাখাইনে লিস্টেড রোহিঙ্গা ধরতে সেনা অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৩ মে ২০১৮

এবার রাখাইনে লিস্টেড রোহিঙ্গা ধরতে সেনা অভিযান

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্যে এবার চিহ্নিত কিছু রোহিঙ্গাকে ধরপাকড়ে অভিযান শুরু হয়েছে। রাজ্যের নলবুনিয়া গ্রামে শনিবার থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা লিস্টেড রোহিঙ্গাদের ধরতে বিভিন্ন গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে নলবুনিয়া গ্রাম থেকে রোহিঙ্গা পুরুষ সদস্যরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপন করেছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে মিয়ানমারে গিয়ে রাখাইন রাজ্য সফর করেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের অনেকে গেল বছরের ২৫ আগস্টের রাতের পর থেকে সেই রাজ্যে সেনা বর্বরতার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছে। যা মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেছে। এতে সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রাখাইন রাজ্য সফরের আগে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ডেকে কোন ধরনের অভিযোগ না জানানোর জন্য তাদের নিষেধ করে দিয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যখন বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ঘটনার বিবরণ জানতে চায় তখন বেশকিছু রোহিঙ্গা প্রকৃত সত্য তুলে ধরে। খুন, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার তথ্যও প্রকাশ করে। ফলে পুরো বিষয়টি মিয়ানমার সরকার সে দেশের সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে গেছে। ইতোমধ্যে বন্ধু এলাকায় বসবাসরত লিস্টেড কিছু রোহিঙ্গাকে প্রশাসনের কাছে হাজির করতে তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষে আগেই হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল যারা নির্দেশ মানবে না তাদের কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। ফলে নলবুনিয়া গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলেও সাহসী কিছু রোহিঙ্গা প্রকৃত সত্য তুলে ধরেন। ওই রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বর্বরোচিত কায়দায় ঘটে যাওয়া সহিংসতার তথ্যও তুলে ধরে। মূলত এ কারণেই সেনাবাহিনী আবারও রোহিঙ্গাদের ওপর ক্ষেপেছে। শুরু হয়েছে বিভিন্ন গ্রামজুড়ে তল্লাশি অভিযান। অপরদিকে, রাখাইন রাজ্যের পর সান রাজ্যেও সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ১৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা, বিদ্রোহী এক সান যোদ্ধা, সরকার সমর্থিত চার মিলিশিয়া ও দুই বেসামরিক সান নারীও রয়েছেন বলে ওপারের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মিয়ানমার সফরে গিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোগিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জোর দিয়েছেন। তিনি সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট এবং সেনা প্রধান মিং অং হ্লাইয়ের সঙ্গেও সাক্ষাত করেছেন। সুষমা স্বরাজ রাখাইন এ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের গৃহীত কর্মসূচীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন বিষয়টি ঝুলেই আছে। বাংলাদেশ থেকে দুদফায় প্রেরিত ৯ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা তালিকার মধ্যে মাত্র ১১শ’ জন রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা বলে নিশ্চিত করে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার পর আর কোন তথ্য মেলেনি। ফলে দিন যতই গড়াচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন অনিশ্চিতার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। একদিকে রাখাইন রাজ্য ও অপরদিকে সান রাজ্যের ঘটনা নিয়ে মিয়ানমার সরকার বর্তমানে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট ভোর রাতে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনা বাহিনী ও বর্ডারগার্ড পুলিশের (বিজিপি) কমপক্ষে ২১ চৌকিতে একযোগে হামলার সাতমাস সময় পর এবার শান রাজ্যে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। চীন সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের শান প্রদেশে শনিবার এ ঘটনা ঘটে। শান বিদ্রোহী গ্রুপ তাঙ্গ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে। শান রাজ্যের অধিবাসীরাও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য। শান অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে মিয়ানমারের কাচিন ও শান প্রদেশে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধবিরতি ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকে সংঘাতের মুখে অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহারা হয়েছে প্রায় ৯০ হাজারের বেশি মানুষ। সহিসংতা থেকে পালিয়ে যাওয়া এসব মানুষদের বেশিরভাগই খ্রীস্টান ধর্মালম্বী। তারা কাচিন প্রদেশের বিভিন্ন গির্জায় আশ্রয় নিয়েছেন। বেশ কিছু কাচিন জনগোষ্ঠী ভারতেও আশ্রয় নিয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সেনাবাহিনী একদিকে তাদের দমনে অভিযানে চালাচ্ছে এবং অন্যদিকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বিদেশি ত্রাণ পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুধু যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে তা নয়, তারা সমগ্র দেশব্যাপী অভিযান শুরু করছে। একেক সময় তারা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে চলছে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।
×