ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঠিক করবেন কারাবন্দী খালেদা ও তারেক

জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির কর্মকৌশল ঠিক হবে দুই সিটির ভোটের পর

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৫ মে ২০১৮

জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির কর্মকৌশল ঠিক হবে দুই সিটির ভোটের পর

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এখনও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মকৌশল ঠিক করতে পারেনি। দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচনের কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে বিএনপি। তবে এ কৌশল কি হবে তা নির্ভর করছে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর। সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও জোটের শরিকদের চাপ বাড়লেও বিএনপি হাইকমান্ড এখনও এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কি হয় এবং গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কেমন হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। তবে এই দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর একটি কর্মকৌশল নির্ধারণ করে তা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেয়া হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীর আগ্রহ থাকলেও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা লাগবে। তবে দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই এখনও এ ব্যাপারে অন্ধকারে রয়েছেন। তারা আশা করছেন দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর এ বিষয়ে হাইকমান্ডের নির্দেশনা পাবেন। জানা যায়, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয় পেতে বিএনপি নানামুখী কৌশল নিয়েছে। প্রকাশ্যে প্রচারের চেয়ে গোপনে প্রচার কাজ চালানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতারা যার যার সুবিধা অনুসারে বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন ও লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন। ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদেরও এ নির্বাচনে সক্রিয় করা হয়েছে । এ দিকে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় এ জন্য দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে ২০ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এরপরও নির্বাচনে অনিয়ম হলে সরকারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনে বিএনপির পক্ষ থেকে যে ২০ দফা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে নির্বাচনের সাত দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার, দুই সিটির প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নির্বাচনে সব প্রার্থীর প্রচারে সমান সুযোগ দেয়া, নিজ ওয়ার্ডের কোন ভোটারকে নির্বাচনের কোন দায়িত্ব না দেয়া, নির্বাচনের আগে দুই সিটির বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেয়া, অভিযোগ কেন্দ্র চালু করে অভিযোগের ১২ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত সংখ্যক পেশাদার পর্যবেক্ষক নিয়োগ, কোন দলীয় নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করার সুযোগ না দেয়া, ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের প্রচার জোরদার করতে ইতোমধ্যেই দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেয়া হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন আর গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দেয়া হয়েছে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব। এ ছাড়া এ দুই সিটিতে ২০ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েও দু’টি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনায় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এনডিপি) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসাকে। আর গাজীপুরে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারকে এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহদাত হোসেন সেলিমকে। সূত্র মতে, দুই সিটি নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হতে চায় বিএনপি। ইতোমধ্যেই কেন্দ্র থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে প্রচারে সরব হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় করা হয়েছে। মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন জোরদার করতে শরিক দল জামায়াতকে দুই সিটিতে ডজনখানেক কাউন্সিলর পদে ছাড় দেয়া হয়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হলে এবং এ কারণে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয় হলে বিএনপি আন্দোলনের পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাইরে রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলেও দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালের ৬ জুলাই। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ মান্নান আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ খানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরই ১৫ জুন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনিরুজ্জামান। তবে এর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা বলার পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপ আসার পরও কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করার সাহস পাচ্ছেন না দলের সিনিয়র নেতারা। একইভাবে তারেক রহমানের কাছেও এ বিষয়টি উত্থাপনের সাহস দেখাচ্ছেন না কোন সিনিয়র নেতা। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কি হয় এবং গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কেমন হয় তা দেখে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতামত নিয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে। এদিকে বিএনপি যাতে সুষ্ঠু পরিবেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে জন্য এখন থেকেই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিদেশী কূটনীতিকদের মাধ্যমেও সরকারের ওপর অনুরূপ চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে আভাস দেয়া হয়েছে এ বছর অক্টোবর মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ঠিক না করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে তা মেনে নেয়া হবে না। এ নিয়ে অবিলম্বে আলোচনার আয়োজন করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির সব দাবি যে পূরণ করতে হবে তা নয়, তবুও আলোচনার ব্যবস্থা করা হোক। আর এর জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে ট্যাকনোক্র্যাট কোটায় নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে চায়। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর চিন্তা নেই। কারণ সংবিধানে এমন কোন সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের কৌশল নির্ধারণ করব। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দুই সিটিতেই আমাদের দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হবে। আর সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে আন্দোলন ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমরা আশা করছি খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে আমরা দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
×