ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আজ কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন ;###;আগামীকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মিয়ানমার যাবেন সেদিনই ;###;চাপের মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সুচিও এখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ চান

নতুন মাত্রা যোগ ॥ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে স্বস্তি পরিষদ দল

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

নতুন মাত্রা যোগ ॥ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে স্বস্তি পরিষদ দল

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে নমনীয় হতে শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার। স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি এখন তার হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছেন। সে কারণে নতুন মাত্রায় একটি সম্পর্ক গড়তে চাইছেন জাতিসংঘের সঙ্গে। সুচিও এখন চান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ থাকুক। এদিকে শনিবার কক্সবাজারে পৌঁছেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। এই প্রতিনিধি দলের সফরে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। টিম সদস্যরা আজ রবিবার উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের কিছুটা নমনীয় হওয়ার তথ্যই দিচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কঠোর সমালোচনা এবং নানামুখী চাপ। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ইতোমধ্যে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচির সম্মাননাও কেড়ে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছেন সুচি নিজেই। ফলে তিনি এই অবস্থা থেকে নিজের উত্তরণ ঘটাবার চেষ্টা করছেন। শুরুতে নানা অজুহাতে টালবাহানা থাকলেও জান্তা প্রভাবিত এই সরকারের এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে আপত্তি নেই। শনিবার দ্য গার্ডিয়ান এবং বিভিন্ন বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, আউং সান সুচি জাতিসংঘের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য একটি সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। তিনি সে দেশে তার রাজনৈতিক অবস্থানও সংহত করার চেষ্টায় মনোযোগী হয়েছেন। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট পদে তারই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির অধিষ্ঠানের পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অনুকূলে আসতে শুরু করেছে। তিনি এখন রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান চান, যদিও তার নিজ দেশে এ বিষয়ে নানামুখী অবস্থান রয়েছে। গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সুচি মনে করেন জাতিসংঘের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা সম্ভব। চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যেমন পর্যবেক্ষণ করবে, তেমনিভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলাকালে অথবা এরপরে আবারও কোন কারণে নৃশংসতা সৃষ্টির আশঙ্কার ওপর দৃষ্টি রাখতে পারবে। অবশ্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, রাখাইন পরিস্থিতি এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল নয়। পত্রিকাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং তাদের নিজ দেশে ফেরাতে প্রথমে দুটি কাজ করতে হবে। এর মধ্যে একটি হলো রাখাইন প্রদেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক করা এবং সেখানকার টাউনশিপে রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া। দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হলো, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের জিরো লাইনে আটকে পড়া ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে যত দ্রুত সম্ভব নিজ ভূমে ফিরিয়ে নেয়া। এ দুটি কাজ করা গেলে বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের মাঝে সাহস ফিরে আসবে। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে। আর নয়তো যত চেষ্টা এবং আশ্বাসই থাকুক না কেন, নৃশংসতার মুখে বিতাড়িতরা পুনরায় রাখাইনে যেতে রাজি হবে না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে পৌঁছেছে। শনিবার কুয়েত থেকে সরাসরি কক্সবাজারে অবতরণ করে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল। বিকেল ৪টা ১০মিনিটে কক্সবাজার বিমান বন্দরে অবতরণ করেন তারা। বিমান বন্দর থেকে সরাসরি ইনানীর পাঁচ তারকা মানের হোটেল রয়েল টিউলিপে রাত যাপনের পর আজ রবিবার তারা উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। পরিদর্শনকালে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন। সীমান্তের জিরো লাইনেও প্রতিনিধি দলের সফরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিনিধি দলে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধিসহ ১০ জন স্থায়ী প্রতিনিধি, পাঁচ জন উপ-স্থায়ী প্রতিনিধিসহ ২৩ জন রয়েছেন। বাংলাদেশ সফর শেষে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি সোমবার মিয়ানমারে গিয়ে পৌঁছাবেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সফর ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হেলিকপ্টারে করে ঘুরে দেখতে আগ্রহী বলে মিয়ানমারকে জানিয়েছেন তারা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি দলের কক্সবাজার সফরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসন কক্সবাজার ও ইনানী এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। মিয়ানমারের সেনা, পুলিশ এবং বিজিপিও উত্তর রাখাইনে টহল জোরদার করেছে বলে জানা গেছে। মংডুর যেসব গ্রামে রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে, তাদেরকে নিজ নিজ বসতঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে কর্তৃপক্ষ। মংডু জাম্বইন্যা এলাকায় নির্মিত ট্রানজিট ক্যাম্পের আশে-পাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা। প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে পৌঁছালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ও মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব) খুরশেদ আলম তাদেরকে স্বাগত জানান। সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সোমবারই তারা মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। মিয়ানমারে দুই দিন অবস্থান করবেন তারা। সূত্র জানায়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৫ সদস্য রাষ্ট্রই একমত হয়েছে। যদিও নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী দেশ চীন ও রাশিয়া তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য মিয়ানমারকে সমর্থন করে আসছে। তবে এই প্রতিনিধি দলে এবার চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিও থাকছেন। নিরাপত্তা পরিষদে একাধিকবার রোহিঙ্গা সঙ্কট ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও নিজ নিজ পক্ষের বক্তব্য দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রায় সব সদস্যের মনোভাব একই রকম। তবে ভেটো পাওয়ারের অধিকারী এমন দুই একটি দেশের কারণে শক্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল মিয়ানমার। প্রতিনিধি দলকে প্রথমে রাখাইন এলাকা পরিদর্শনের অনুমতি দিতে চায়নি মিয়ানমার। তবে মিয়ানমার চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের রাখাইনে যেতে দিতে রাজি হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা পরিষদের সদস্যদের রাখাইন ও কক্সবাজার সফরের বিষয়ে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সফরে রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিষয়টিই তাদের মূল ফোকাস। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি জানিয়েছেন, রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি দেখার চেয়ে তাদের সফরে ভাল কিছু আর হতে পারে না। প্রসঙ্গত, রাখাইনে পুলিশ চৌকিতে হামলার অজুহাতে ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬, ২০১৭ ও চলতি ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করলে অন্তত ছয়বার লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এরমধ্যে এবার অনুপ্রবেশের সংখ্যা অন্যবারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। একসঙ্গে এত রোহিঙ্গা আগে আসেনি। চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আগে থেকে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। উখিয়া এবং টেকনাফে রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগুরু। বাংলাদেশী পাসপোর্টে বিদেশে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা ॥ বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে, একথা নতুন নয়। কিন্তু এবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি নিজেই বললেন, দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তারা তাদের অর্জিত অর্থ মিয়ানমারেই পাঠাচ্ছে। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী এ তথ্য জানান। ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স সিরিজের অংশ হিসেবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেন্টার পর এনআরবি (নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশী)। মন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর জন্য সিন্ডিকেট হয়েছে। তবে তা সে দেশের সিন্ডিকেট। বিভিন্ন দেশে গেলে বাংলাদেশী পরিচয়ে অনেকেই আসে দেখা করতে। কিন্তু বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে রোহিঙ্গা পরিচয়ই জানা যায়।
×